বাংলাদেশে ব্যবসার মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী?
নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্সের (বিবিএক্স) প্রকাশিত ফলাফলে সামান্য উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংক ঋণ এবং অর্থায়নসহ দেশের বর্তমান কর পরিবেশের কারণে ব্যবসা সেক্টরে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
রাজধানীর এমসিসিআই মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২২-২৩’-এর ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের মধ্যে ৫১৮টিরও বেশি প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ (পিইবি) যৌথভাবে এ সূচকটি তৈরি করেছে। গত দুই বছর ধরে তারা বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) প্রকাশ করছে।
মূল সূচকে উন্নতির পাশাপাশি দেশী ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য সুবিধার সর্বশেষ তথ্য নিশ্চিত করার লক্ষে মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের ওয়েবসাইটগুলোর আধুনিকীকরণ এবং আপগ্রেডেশনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন বিশেষজ্ঞরা।
জরিপের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করে পিইবি চেয়ারপারসন ডা. মাসরুর রিয়াজ জানান, বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ১০টি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এগুলো হলো- ব্যবসা শুরু করা, জমিতে প্রবেশাধিকার, নিয়ন্ত্রক তথ্যের প্রাপ্যতা, অবকাঠামো, শ্রম নিয়ন্ত্রণ, বিরোধ নিষ্পত্তি, বাণিজ্য সুবিধা, কর প্রদান, প্রযুক্তি গ্রহণ এবং অর্থের অ্যাক্সেস।
এই স্তম্ভগুলোতে আরও ৩৫টি উপ-সূচক রয়েছে। যা সূচক গণনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে বিবিএক্স’র ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ ৬১.৯৫ স্কোর করে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি করেছে। যা ২০২১ সালে ৬১.০১ স্কোর ছিলো। তবে এই খাতে আরও উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে।’
ডা. মাসরুর বলেন, ‘ভূমি স্তম্ভে প্রবেশের প্রধান বাধার মধ্যে রয়েছে; অনুষ্ঠানিক অর্থপ্রদান, ভূমি স্থানান্তর এবং মধ্যস্থতাকারীদের সম্পৃক্ততা। উচ্চ কর, কম কম ও দুর্বল করদাতা পরিষেবা সম্পর্কে অজ্ঞতাই কর প্রদানের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, ক্রেডিট প্রক্রিয়া জটিলতায় অ্যাক্সেস, রেট ক্যাপিং ও ক্রেডিট রেশনিং এবং জটিল ডকুমেন্টারির প্রয়োজনীয়তাগুলো আর্থিক স্তম্ভে বাধা হয়ে থাকে।’
জরিপের ফলাফলগুলোতে দেখা যায়, ‘অ্যাকসেস টু ল্যান্ড ইন্ডিকেটর’ সূচকে ২০২১ সালে ৫৮.৯০ এর তুলনায় ৯.৯০ শতাংশ কমে ২০২২ সালে ৫৩.০৭ এ দাঁড়িয়েছে। একইভাবে, কর পরিশোধে ১৯.৬৬ শতাংশ কমে ৫৫.২১ শতাংশ হয়েছে, যা ২০২১ সালে ৬২.৭২ শতাংশ ছিল।
এদিকে, ‘অ্যাক্সেস টু ফাইন্যান্স’ সূচকে ২০২১ সালে ৫০.৭৮ এর তুলনায় ৩০.৬৫ শতাংশে কমে ২০২২ সালে ৩৫.২২ এ দাঁড়িয়েছে।
‘নতুন ব্যবসা শুরু’ সূচকে ২০২১ সালে ৬৮.৯১ থেকে ২.৭২ শতাংশ বেড়ে ২০২২ সালে ৭০.৭৮ হয়েছে। ‘নিয়ন্ত্রক তথ্যের প্রাপ্যতা’ সূচকে ২০২২ সালে ২১.৭৭ শতাংশ বেড়ে ৫৯.৮৩ থেকে ৭২.৮৫ তে পৌঁছেছে। ‘কাঠামো’ সূচকে ২০২২ সালে ৩.৪৩ শতাংশ উন্নতি করে ৭২.০২ স্কোর থেকে ৭৪.৪৯ স্কোরে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে ‘শ্রম নিয়ন্ত্রণ’ সূচকে ২০২১ সালে ৬৬.৩৫ থেকে ২০২২ সালে ১২.১৩ শতাংশ বেড়ে ৭৪.৪০ হয়েছে। ‘বিরোধ নিষ্পত্তি’ সূচকে ২০২১ সালে ৫৭.৪৮ থেকে ২০২২ সালে ১১.৭৫ শতাংশ বেড়ে ৬৪.২৪ এ দাঁড়িয়েছে। ‘বাণিজ্য বৃদ্ধি’ সূচকে কোন পরিবর্তন না হয়ে গত বছরের মতোই রয়েছে।
এছাড়াও, ‘প্রযুক্তি গ্রহণ’ সূচকে ২০২১ সালে রেকর্ড করা ৫৭.৭০ থেকে ২০২২ সালে ৫.০৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬০.৬০ এ দাঁড়িয়েছে।
পিইবি চেয়ারপারসন ডা. মাসরুর বলেন, ‘বিবিএক্স প্রতিবেদনে ৬০ শতাংশেরও বেশি উত্তরদাতাদের দাবী, তারা দেশের আয়কর ও ভ্যাট দাখিল এবং পরিশোধের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভাবে বাধার সম্মুখিন হয়েছে। ৭৬ শতাংশই জানিয়েছে, দেশের বর্তমান কর পরিবেশের কারণে তাদের ব্যবসার উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।’
এছাড়াও প্রায় ৮৭ শতাংশ উত্তরদাতা উল্লেখ করেছেন, তারা ব্যাংক ঋণ এবং অর্থায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। এ ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য আরও তীব্র হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও জানান তারা।
অনুষ্ঠানে মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের চারপাশে এক সাথে অনেক কিছুই ঘটছে। যেমন মার্কিন ডলার সংকট, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি, সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি, করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এসবের কারণে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।’
এমসিসিআই সবসময় দায়িত্বশীল ব্যবসার কণ্ঠস্বরকে বিশ্বাস করে উল্লেখ করে সাইফুল ইসলাম জানান, একটি দেশের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক সম্ভাবনার মূল্যায়ন করার জন্য একটি দেশের ব্যবসায়িক আবহাওয়ার পরিমাপ করা অনেক বেশি প্রয়োজন। আমরা এই সূচক থেকে ব্যবসা এবং বিনিয়োগ বিকাশের সম্ভাবনা মূল্যায়ন করতে পারি। আগে আমরা বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অফ ডুয়িং’ বিজনেসসহ অন্যান্য সূচক দেখেছি। কয়েক বছর আগে এটি বন্ধ হওয়ার পর থেকে, আমরা এই শূন্যতা পূরণের জন্য অনুরূপ সূচকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমরা বিনিয়োগকারীকে আমাদের সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে প্রস্তুত। তবে সবাইকে অবশ্যই সরকারী নীতি-ব্যবস্থাপনা মেনে চলতে হবে। সেই সাথে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জন করতে একসাথে কাজ করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ‘প্রথমে বাংলাদেশকে আরও বেশি সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আনতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের চাহিদা পূরণ করতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা একটি দেশে বিনিয়োগের আগে তথ্য সংগ্রহের জন্য ওয়েবসাইটগুলো অনুসন্ধান করে। আমাদের এই সেগমেন্ট নিয়ে কাজ করতে হবে। সেই সাথে সময়ের অপচয় কমাতে বন্দর এবং বিমানবন্দরগুলোতে লজিস্টিক সমস্যাগুলোর অবশ্যই উন্নত করতে হবে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সমস্যায় পড়লে কোনো সুফল বয়ে আনবে না। সুতরাং, আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে এবং সমস্ত সমস্যা সমাধান করতে হবে। তারপর বিনিয়োগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসবে।’
এ সময় মন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করতে সক্ষম হবে।
ভৌগোলিক বণ্টনে ময়মনসিংহ জেলা সর্বোচ্চ স্কোর ৬৫.২৩ রেকর্ড করেছে। যেখানে রংপুর ২০২২ সালে ৫৫.৭৬ এ নেমে এসেছে। সূচকে সিলেট ৬৫, চট্টগ্রাম ৬০.৮১, রাজশাহী ৫৯.৫৭, ঢাকা ৫৮.৬৭ স্কোর করেছে।
এছাড়াও ব্যবসায়িক পরিবেশ নির্মাণ খাতে ৬৬.০২, চামড়া ও ট্যানারি খাতে ৬৫.৩৩, খাদ্য ও পানীয় খাতে ৬২.৬২, তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে ৬২.৩১, পরিবহন, সঞ্চয় ও যোগাযোগ খাতে ৬১.৯৩, ইলেকট্রনিক্স ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে ৬০.৯৩, আর্থিক মধ্যস্থতাকারী খাতে ৮৬.৮৬।
ভাড়া ও ব্যবসা খাতে ৫৯.৩৩, পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য খাতে ৫৮.৮৪, কৃষি ও বনজ খাতে ৫৮.২২, ওষুধ ও রাসায়নিক খাতে ৫২.২৪ এবং টেক্সটাইল খাতে ৪৮.০২ স্কোর পেয়েছে বাংলাদেশ।
বিবিএক্স বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক পরিবেশ সূচক প্রবর্তন করেছে; যা বেসরকারী বিনিয়োগকারীদের এবং সরকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবসার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে সময়োপযোগী এবং বিস্তারিত তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে অনন্য।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, বিল্ডের চেয়ারপারসন এবং এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির।