আসছে রমজান বাড়ছে দাম
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিয়ন্ত্রন অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে
শাহ আলম নূর : রমজানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম রোজার মাসের প্রায় দুই মাস আগে ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন আসছে রমজান বাড়ছে পণ্যের দাম। অর্থাৎ রমজানের উপলক্ষে দামের নাটাই অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে।
ডলারের বাজারে অস্থিরতার মধ্যে পণ্য আমদানির সংকট এবং ব্যবসায়ীদের একটি অংশের দ্বারা পণ্যের মজুত দাম বৃদ্ধির মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
তারা বলছেন সরকারি গুদামগুলোতে সোয়া ১৯ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য (চাল-গম) মজুত আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের মজুতও সন্তোষজনক। আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম নিম্নমুখী। আমদানি অব্যাহত রাখতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনেক পণ্যের শুল্ক ছাড় দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম না বাড়ালে আসন্ন রমজান মাসে কোনো পণ্যের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তবে ডলারসংকটে রোজায় অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি (ঋণপত্র) খোলার সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টরা।
রমজান মাস এলেই কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। রোজার দুই মাস বাকি থাকলেও এই মাসটিকে ঘিরে প্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের দাম এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। সাধারণত চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কম থাকে। কিন্তু বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি থাকার পরও দাম বাড়ছে।
রোজা সামনে রেখে ছোলা, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, খেঁজুরসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের বাজার চড়া হয়ে উঠেছে। দাম কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে শুল্কছাড়সহ নানা নীতি-সহায়তা দিলেও এর প্রভাব পড়ছে না। মূলত মিল ও মোকাম পর্যায় থেকেই দাম বাড়ায় পাইকারিতে এর প্রভাব পড়েছে। ফলে খুচরা বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ নির্দেশনা ও ডলার সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে। এর পরও ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুত করে দাম বাড়িয়ে দেয়। ভোক্তা অধিকার আইন প্রয়োগ করে এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। না হলে মজুত কারবার বন্ধ হবে না।’
দেশে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম কমেছে। এই মুহূর্তে কোনো পণ্যের দাম কমা ছাড়া বাড়ার কোনো কারণ নেই। তার পরও যদি পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে অথবা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দেবে। তিনি এও বলেন, রোজায় পণ্য আমদানিতে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে আশ্বাস দিচ্ছে তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন গোলাম রহমান।
এদিকে রোজার মাসে কেউ যেন ভোক্তাদের জিম্মি করতে না পারে, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের সতর্ক থাকতে বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের একটি সেশনে মতবিনিময়ে তিনি এ নির্দেশনা দেন।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সম্মেলনে ২ মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে ৩০ সেকেন্ড বলেছি রোজায় বাজার পরিস্থিতি নিয়ে। সেখানে বলেছি, রমজান মাস সামনে রেখে কেউ যাতে সুযোগ নিতে না পারে। আপনারা সরকারের হাত। আপনারা খেয়াল রাখবেন কেউ যাতে সুযোগ না নেয়। শক্ত ব্যবস্থা নেবেন।’
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘রোজায় পেঁয়াজের চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম চলছে। এবার রোজায় এই পণ্যের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। এদিক দিয়ে স্বস্তি পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেল, চিনি, ডালসহ সব পণ্যের দামই এখন অনেক কমেছে। অনেক পণ্যের দাম করোনার আগের অবস্থানে চলে এসেছে। সরকার কঠোরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে এবার রোজায় পণ্যমূল্য বাড়বে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বার্ষিক চিনির মোট চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন। স্থানীয়ভাবে আখ থেকে ৩০-৩৫ হাজার টন চিনি উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানি করেই মেটানো হয়। পরিশোধিত চিনি উৎপাদনের জন্য অপরিশোধিত চিনি প্রায় ২০ লাখ টন আমদানি করা হয়।
সারা বছর প্রতি মাসে গড়ে চিনির চাহিদা দেড় লাখ টন থাকলেও রমজানে চিনির চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়, অর্থাৎ তিন লাখ টনে উন্নীত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২২ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ২৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের চিনি আমদানি করা হয়েছে। কাস্টমসের হিসাবে, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে দেশে মোট ৭ লাখ ৩৩ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা আড়াই থাকে তিন লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় দুই লাখ টন। অর্থাৎ ১৮ লাখ টন ভোজ্যতলে আমদানি করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২২ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১৫৬ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে, ২০২১ সালের একই সময়ে যা ছিল ১১১ কোটি ৩১ লাখ ডলার। অর্থাৎ আমদানি বেড়েছে ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে রোজার মাসে চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ টন। কিন্তু স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকালে ২৫ শতাংশ ক্ষতি হয়। দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয় ছয় থেকে সাত লাখ টন। ২০২১ সালের মে-অক্টোবরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ১২৫ টন। ২০২২ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ১০৩ টন। ফলে আমদানি কমেছে ২১ শতাংশ।
সরকারি হিসাবে দেশে বছরে ছোলার চাহিদা এক লাখ টন। এর মধ্যে রোজার মাসেই প্রয়োজন হয় ৮০ হাজার টন। মাত্র ছয় হাজার টন স্থানীয় উৎপাদনের বিপরীতে আমদানি করতে হয় আরও প্রায় এক লাখ টন। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ছোলা আমদানি হয়েছে সাড়ে ৫৩ হাজার টন।
দেশে বছরে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজান মাসেই চাহিদা ২৫ হাজার টন। ফলে প্রতিবছরই এর প্রভাব পড়ে দামে। ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আমদানি হয়েছিল ১১ হাজার ৭৭৩ টন।
বছরে মসুর ডালের চাহিদা পাঁচ লাখ টন। রমজানে এই চাহিদা ৭০ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২ লাখ ৬ হাজার টন। আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয় ৩ লাখ ৫০ হাজার টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে মুসর ডাল উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ টন। আমদানির তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৯৯ হাজার টন।
বর্তমানে ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা আগামী দু-এক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) নবনির্বাচিত পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এমন কথা বলেছেন।
গভর্নর বলেন, ‘রজমান মাসে কোনো পণ্যের যাতে কোনো ধরনের ঘাটতি না হয়, সে জন্য দুই মাস ধরেই ব্যবসায়ীদের সহায়তা করা হচ্ছে। কারও এলসি খুলতে সমস্যা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। আশা করছি, এবার রমজানে পণ্য আমদানিতে কোনো সমস্যা হবে না।