সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গছে বেশি কিনছে কম
শাহ আলম নূর : আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় সঞ্চয়পত্রের উপর প্রভাব পড়েছে। দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির কারনে মানুষ সঞ্চয়পত্র ক্রয় করছে কম। একই সাথে বিক্রি করছে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন নানা কারণে কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। ফলে আগের কেনা সঞ্চয়পত্র মেয়াদ পূর্তির পর যে হারে ভাঙানো হচ্ছে, সেই হারে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। যার কারণে ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না বেড়ে কমেছে অর্থাৎ ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উলটো ৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
ডলার, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতিতে। মূল্যস্ফীতি বাড়ার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার দাম অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষ। ব্যয়ের সঙ্গে আয় না বাড়ায় জীবিকা নির্বাহ করতে একদিকে জীবনযাত্রার মানে লাগাম টানতে হয়েছে, অন্যদিকে হাত পড়েছে সঞ্চয়ে। অনেকে এখন সঞ্চয় ভেঙে সংসার খরচ মেটাচ্ছেন।
মানুষের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা কমছে কিনাÑতা বোঝার সবচেয়ে বড় উপায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি এবং আমানতের প্রবৃদ্ধি। সঞ্চয় পরিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ কমেছে ৩ হাজার ১০৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৪০ হাজার ৪৭১ কোটি ৮২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে পরিশোধ হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, সেটিকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) সঞ্চয়পত্রে যথাক্রমে ৩৯৩ কোটি টাকা ও ৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ বেড়েছিল। তবে সেপ্টেম্বর থেকে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে ভাটা শুরু হয়। সেপ্টেম্বরে নিট বিনিয়োগ কমেছে ৭০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। শুধু সেপ্টেম্বর নয়, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে যথাক্রমে ৯৬৩ কোটি টাকা, ৯৮৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং ডিসেম্বরে ১ হাজার ৪৯০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা নিট বিক্রি কমেছে। অর্থাৎ এখন মানুষ যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছে, তার চেয়ে বেশি ভেঙে ফেলছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতির তুলনায় সুদহার কম। সুদহার কম হওয়ায় মানুষ বিনিয়োগ করতে পারছে না। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী আয় বাড়ছে না। তাই বিনিয়োগ কমেছে।
তিনি আরও বলেন, সঞ্চয়পত্রে এখন নানা ধরনের নিয়ম করা হয়েছে। কড়াকড়ির কারণেই মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। যারা মূলত অনিয়ম করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। সবাই তো আর অনিয়ম করে না। অল্প বিনিয়োগ যারা করে তাদের জন্য এ নিয়ম মানা কঠিন। তাই এখানে তারা বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১৫ লাখ ৫৬ হাজার ৩১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৯৬৪ কোটি ৪ লাখ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ৮৬ হাজার ৯৩২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০২২ সালে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, যা ২০২১ সালের চেয়ে কম। ২০২১ সালে সামগ্রিকভাবে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন মানুষ তিনটি কারণে আর সঞ্চয়পত্র কিনছেন না। প্রথমত, ৫ লাখ টাকার ওপরে সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে রিটার্ন দিতে হচ্ছে। কিন্তু নানা ঝামেলায় অনেকেই রিটার্ন দিতে চান না। ফলে তারা এ খাতে বিনিয়োগ থেকে সরে আসছেন। দ্বিতীয়ত, অনেকের ১ কোটি টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ছিল। কিন্তু সীমা নির্ধারণের কারণে এসব সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে তারা আর নতুন করে কিনতে পারছেন না। তৃতীয়ত, মানুষের হাতে এখন টাকা কম। মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছে না। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার কম ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেশি নিচ্ছে, যা আরও ক্ষতিকর। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা সরাসরি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে।
তিনি আরও বলেন, বাজার অর্থনীতিতে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (আরওআই) বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা যদি বিভিন্ন বাজারে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট দিতে না পারি, তাহলে উন্নতি করা কিন্তু কঠিন হবে। কারণ যারা সঞ্চয়কারী, তারা যে শুধু সঞ্চয় দেশে রাখবে তা নয়, তারা বিদেশেও সঞ্চয় করতে পারে। কাজেই আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হবে। নইলে টাকা পাচার হয়ে যাবে। তাই সঞ্চয়কে বাজারে আকর্ষণীয় রাখতে হবে।
সর্বশেষ চলতি অর্থবছর ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার।