বেড়েই চলেছে মামলা
এক দশকে কর ফাঁকি ৩২ হাজার কোটি টাকা
শাহ আলম নূর : প্রকৃত আয় গোপন রেখে এবং ব্যবসায় ক্ষতি দেখিয়ে গত ১০ বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি আয়কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। আর তা করেছে ২ লাখ ২০ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) এ ধরনের মামলার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে ১০ বছরে দাখিল করা রিটার্ন অডিট করে করফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। অনাদায়ী রয়েছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।
মূলত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রকৃত আয় গোপন ও ব্যবসায় লোকসান দেখিয়ে এ বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিয়েছে। অপরদিকে ক্রুটিপূর্ণ রিটার্ন প্রসেস করে ১০ বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত দাবি করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১৫৪ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। আর অনাদায়ী রয়েছে প্রায় ৯১৭ কোটি টাকা। কর অঞ্চলগুলো রিটার্ন অডিট ও রিটার্ন প্রসেস করে এ ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। তবে বেশিরভাগ করদাতা ফাঁকি দেয়া কর পরিশোধ না করে আপিল, ট্রাইব্যুনাল ও আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। ফলে বছরের পর বছর ফাঁকি দেয়া কর অনাদায়ী রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন জমার পর তা দুই পদ্ধতিতে যাচাই হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রথমত, ৮২ বিবি (২) ধারা অনুযায়ী উপকমিশনার ত্রুটিপূর্ণ রিটার্ন বাছাই করেন। সে রিটার্নের গাণিতিক ত্রুটি-বিচ্যুতি বের হলে বা হিসাবের গরমিল পাওয়া গেলে করদাতাকে নোটিশের মাধ্যমে তা জানিয়ে সংশোধিত রিটার্ন জমা দিতে চিঠি দেন। দ্বিতীয়ত, এনবিআরের অনুমোদন নিয়ে ৮২ বিবি (৭) ধারা অনুযায়ী, রিটার্ন অডিট করা হয়। সাধারণ বড় রিটার্ন এ পদ্ধতিতে অডিটের জন্য নির্বাচন করা হয়।
এনবিআরের অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনের তৈরি করা প্রতিবেদনে অডিটের বিষয়ে বলা হয়েছে, ২০১০-১১ করবর্ষ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত মোট ১০ বছরে ২ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪টি রিটার্ন অডিটের জন্য নির্বাচন করা হয়। এর মধ্যে ৩ হাজার ২৭৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়নি, প্রক্রিয়াধীন ৩ হাজার ২৭৮টি। বাকি ২ লাখ ১৭ হাজার ৫৭টি রিটার্ন অডিট করে ৩৩ হাজার ৩৯৭ কোটি ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার ৯৭২ টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটন বা দাবি সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে চলতি করবর্ষের অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৯ হাজার কোটি ৮ লাখ ১৬ হাজার ৩১৭ টাকা। অনাদায়ী বা বকেয়া রয়েছে ২৪ হাজার ৩৯৭ কোটি ৩০ লাখ ৬৯ হাজার ৬৫৫ টাকা। অক্টোবরে আদায় হয়েছে ৮১৬ কোটি ৬৭ লাখ ২১ হাজার ৯৪৭ টাকা।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১০-১১ করবর্ষে সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৫২৭টি। এর মধ্যে অডিটের জন্য নির্বাচন করা হয় ১০ হাজার ৯৪টি। এসব রিটার্ন অডিট করে প্রায় ২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা ফাঁকি উদঘাটন বা দাবি সৃষ্টি করা হয়। এর মধ্যে চলতি করবর্ষের অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে প্রায় ২৩৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অনাদায়ী বা বকেয়া রয়েছে প্রায় এক হাজার ৯০১ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১১-১২ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৬ লাখ ৮৯ হাজার ২টি। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৮৪০টি অডিট করে প্রায় দুই হাজার ৭১৬ কোটি টাকা ফাঁকি উদঘাটন বা দাবি সৃষ্টি করা হয়। চলতি করবর্ষের অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে প্রায় ৭৩৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অনাদায়ী রয়েছে প্রায় এক হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৮ লাখ ৫৪ হাজার ২৬৬টি। এর মধ্যে ২০ হাজার ৫৮৪টি অডিট করে প্রায় ৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা ফাঁকি উদঘাটন বা দাবি সৃষ্টি করা হয়। অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে প্রায় এক হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। অনাদায়ী রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা।
২০১৩-১৪ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৮ লাখ ৮৯ হাজার ৮৭৬টি। এর মধ্যে ৩২ হাজার ৩৪৪টি অডিট করে ফাঁকি উদঘাটন বা দাবি সৃষ্টি হয় প্রায় ৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে প্রায় ৭২৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অনাদায়ী রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৭১৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৯ লাখ ৪২ হাজার ৫৬৯টি। এর মধ্যে ২০ হাজার ৬৪৩টি অডিট করে প্রায় ৪ হাজার ৯৬১ কোটি ৬০ লাখ টাকার ফাঁকি পাওয়া গেছে। অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অনাদায়ী রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ৫ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৯ লাখ ৮৪ হাজার ৪৯৩টি। এর মধ্যে ২২ হাজার ৯টি অডিটের জন্য নির্বাচন করা হয়। যার মধ্যে ৩৩টি মামলা ছাড়া বাকি সব মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে ফাঁকি উদ্ঘাটন বা দাবি সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৯৮০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। যার মধ্যে আদায় হয়েছে প্রায় ৪২৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে আবার অক্টোবরে আদায় হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। অনাদায়ী রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫৫৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ৮১৮টি। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৩৮০টির মধ্যে একটি ছাড়া বাকি রিটার্ন অডিট করা হয়। এতে ফাঁকি দাবি সৃষ্টি করা হয় প্রায় ২ হাজার ১৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আদায় হয়েছে প্রায় ৩৭৬ কোটি ১২ লাখ টাকা। তবে অক্টোবরে আদায় হয়েছে প্রায় ১৬ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অনাদায়ী রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৬৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
২০১৭-১৮ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮টি। এর মধ্যে ২৫ হাজার ২৯৪টি অডিট করে ফাঁকি উদ্ঘাটন বা দাবি সৃষ্টি করা হয় প্রায় ৩ হাজার ৩০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৩০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এই করবর্ষে প্রায় ৯৯৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় হয়েছে। তবে উদ্ঘাটন করা করের মধ্যে চলতি করবর্ষের অক্টোবরে আদায় হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। ২০১৮-১৯ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ১৭ লাখ ৭ হাজার ১২৪টি। এর মধ্যে ২৬ হাজার ২৩৮টি রিটার্ন অডিট করে ফাঁকি উদ্ঘাটন বা দাবি সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ২ হাজার ২৮৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আদায় হয়েছে প্রায় ৪১২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে অক্টোবরে আদায় হয়েছে প্রায় এক কোটি ৪৬ লাখ টাকা। অনাদায়ী রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৭৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ করবর্ষে সর্বজনীন পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে অডিট করা হয় ২১ হাজার ৯০৮টি। আর ১৮ হাজার ৬৬৫টি মামলা নিষ্পত্তি হলেও ৩ হাজার ২৪৩টি মামলা প্রক্রিয়াধীন। ফাঁকি উদ্ঘাটন বা দাবি সৃষ্টি করা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৩০৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আদায় হয়েছে প্রায় ২৬১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। চলতি করবর্ষের অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে প্রায় ৮৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অনাদায়ী রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৪৭ কোটি ২১ লাখ টাকা।
অপরদিকে, ত্রুটিপূর্ণ রিটার্ন প্রসেস করার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১-১২ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত মোট ১০ বছরে ৮২ বিবি (২) ধারায় ত্রুটিপূর্ণ রিটার্ন প্রসেস করা হয়েছে মোট এক লাখ ৪ হাজার ১০২টি। এতে অতিরিক্ত করের দাবি সৃষ্টি করা হয়েছে মোট এক হাজার ৭২ কোটি ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫ টাকা। এর মধ্যে চলতি করবর্ষের অক্টোবর পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে মোট ১৫৪ কোটি ৭১ লাখ এক হাজার ৭৯৬ টাকা। এর মধ্যে অক্টোবরে আদায় হয়েছে এক কোটি ৪ লাখ ৬৮ হাজার এক টাকা। আর মোট অনাদায়ী রয়েছে ৯১৭ কোটি ৬২ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৯ টাকা।
এ প্রসঙ্গে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেকেই ঠিকমতো কর না দিয়ে উল্টো মামলা করে প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ করছেন। এক্ষেত্রে আইনের এই ফাঁকফোকর বন্ধ করতে না পারলে এ ধরনের অনিয়ম বাড়তেই থাকবে। এনবিআর চাইলেও অনেক কিছুই করতে পারবে না। এজন্য আইনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য তিনি পরামর্শ দেন।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইনি জটিলতার কারণে এ সমস্যাগুলো হয়। মামলা করা হয়েছে, মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লেগে যায়। এটার বিকল্প হিসেবেই অলটারনেটিভ ডেসপুট রেজল্যুশন (এডিআর) করা হয়েছিল। সেটাও কাজে লাগছে না। মামলা হলে ১৫-২০ বছর আটকে থাকলে তাদের (কর ফাঁকিদাতা) সাশ্রয় বেশি। আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হলে কর আইনের সংস্কার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন কর ফাঁকির পেছনে প্রশাসনিক অদক্ষতা বা দুর্নীতিই মূল বাধা। দুর্নীতি তো আইনে সংস্কার করে কমানো যাবে না বা বন্ধ করা যাবে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে অটোমেশন, কিন্তু অটোমেশন হলেই সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে তা-ও না। ই-জিপি দেখলে সেটাই বোঝা যায়। সবচেয়ে বড় কথা দুর্নীতি বন্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। করদাতা যে পরিমান টাকা দেন আর সরকারি কোষাগারে যে পরিমান টাকা জমা হয়-এই দুটোর মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য। মাঝখান দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে কর কর্মকর্তারা একটা বড় পরিমাণ টাকা নিয়ে নেন। সেটা কোনো ছোটখাটো অংশ না।