আমরাই দেশে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে এনেছি: আলজাজিরাকে প্রধানমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক : জাতিসংঘের আয়োজিত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সম্মেলনে যোগ দিতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে কাতারে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সম্মেলনের ফাঁকে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার সাংবাদিক নিক ক্লার্ক প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেন। শনিবার (১১ মার্চ) সাক্ষাৎকারটি প্রচার করেছে সংবাদমাধ্যমটি। সেখানে রোাহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কি না জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী নির্বাচন শতভাগ নিরপেক্ষ হবে। আগের দুই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, তারা কোনো কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল এবং মানুষ আমার দলের পক্ষেই ভোট দিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। কেন? কারণ, তাদের দলের নেতারা দুর্নীতি, অস্ত্র পাচার, গ্রেনেড হামলার মতো অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত।’
পশ্চিমা গণমাধ্যমকে প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পশ্চিমা গণমাধ্যম যারা আমাকে স্বৈরাচারী শাসক বলে, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, যখন আমার দেশে সেনা শাসন ছিল, তখন এটিকে আপনারা কীভাবে বিচার করবেন?’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭৫ সালে আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করলো সেনাবাহিনী। আমি দেশে আসতে পারিনি। শরণার্থী হয়ে বিদেশে থাকতে হয়েছে। যখন ফিরে আসলাম, আমাকে মামলা পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। তারা বহুবার আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। গ্রেনেড হামলা করেছে। আমি কোনও বিচার পাইনি। তারা বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছে। সেই জায়গা থেকে সংগ্রাম করে আমরা মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে এনেছি।’
দেশের উন্নয়নের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রেখেছি। এতে দেশে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে, জিডিপি বাড়ছে। আমার বাবা বেঁচে নেই, কিন্তু আমি তার আদর্শ অনুসরণ করি। আমি চেষ্টা করি, তিনি যেভাবে চেয়েছিলেন, সেভাবেই দেশের মানুষের সেবা করছি। এ কারণেই ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের চেহারা অনেকটাই পাল্টে গেছে।’
অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বে কারা ছিলেন, এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল; তারা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই করেনি, তারা মানুষকে হত্যা করেছে, আমাদের দেশকে ধ্বংস করেছে, অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। সে সময় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আমাদের দেশের নাম পাঁচবার এসেছে। অন্য অনেকের মতো আমিও ভুক্তভোগী হয়েছি।’
বিএনপির আগ্রাসী রাজনীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা আমাকে একাধিকবার হত্যা করার চেষ্টা করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে (২১ আগস্ট) তারা আমার ওপর হামলা চালিয়েছে। নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ আমার দলের ২২ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি এ নিয়ে কোনও তদন্ত, এর কোনও বিচার পর্যন্ত হয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু তা-ই নয়, তাদের (বিএনপি) দুর্নীতির বিষয় দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রমাণিত হয়েছে। এরপর তাদের সন্ত্রাসবাদ। দেশের পাঁচ শতাধিক স্থানে এক ঘণ্টার মধ্যে তারা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তাদের অপকর্মের জন্য তখন জরুরি অবস্থাও জারি হয়েছিল। আমি দেশের মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছি, আমি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি।’
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমরা বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হই। তবে এটি কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় তা আমরা জানি। এ বিষয়ে আমাদের সব প্রস্তুতিও রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছি। যেকোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে সহায়তা করার জন্য ৮৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণও দিয়েছি।’
কয়েকটি দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় সাফল্যের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সীমিত সম্পদ নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশের মানুষ দুর্দান্ত। আসলে যেকোনও কাজেই আমরা কয়েক ধাপে পরিকল্পনা করি। দীর্ঘমেয়াদি, স্বম্পমেয়াদি এমনকি তাৎক্ষণিকভাবেও অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এভাবে আমরা পরিকল্পনামাফিক দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের আইসিটি খাতে গুরুত্বারোপের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন দেশের সর্বত্র ইন্টারনেট আছে। সাবমেরিন ক্যাবল, ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে মানুষকে সারা বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করেছি। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছিলাম; এখন দেশের প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে।’
মিয়ানমারে নিপীড়ন, হত্যা ও ধর্ষণের শিকার এবং দেশচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সংকট সমাধানে আমরা আলোচনা চাইলেও নিজেদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক নয় মিয়ানমার।’
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে আলজাজিরার প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমারে যখন রোহিঙ্গা নিপীড়ন শুরু হয়, তখন আমরা তাদের জন্য দুঃখ অনুভব করি। এরপর আমরা সীমান্ত খুলে দিয়েছি, তাদের আসতে দিয়েছি। এ ছাড়া মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের জন্য আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।’
‘এসবের পাশাপশি আমরা মিয়ানমারের সঙ্গেও কথা বলতে শুরু করি। আমরা তাদের রোহিঙ্গাদের নেওয়ার অনুরোধ করি। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে তারা ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে না। আসলে রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশে ফিরে যেতেই হবে।’ যোগ করেন তিনি।
রোহিঙ্গা শিবিরে জীবনযাত্রার পরিস্থিতি এবং আগুনে ১২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার আশ্রয় হারানো প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তারা (রোহিঙ্গারা) একে অপরের সঙ্গে লড়াইরত। তারা মাদক, অস্ত্র ও মানবপাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে জড়িত। তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও সেখানকার শরণার্থীদের কারণে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে যাচ্ছে। এতে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠছে।’
বিপুল রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে গিয়ে বনাঞ্চল কেটে উজাড় করতে হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আলজাজিরাকে বলেন, ‘পরিবেশের বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেছে। পাহাড় কেটে তাদের ক্যাম্প করে দিতে হয়েছে। স্থানীয় মানুষ পড়েছে বেশি বিপদে। সব মিলিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়।’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করেছি। ভাসানচর থাকার জন্য ভালো জায়গা। আমরা সেখানে তাদের জন্য ভালো থাকার ব্যবস্থা এবং চমৎকার সুবিধার ব্যবস্থা করেছি।’