শেষের দিকে মার্চ মাস, সুখবরের দেখা পেল না পুঁজিবাজার
শাহ আলম নূর : মার্চ মাস থেকে দেশের পুঁজিবাজারে সুখবর আসবে। অর্থাৎ শেয়ার বাজারে লেনদেন স্বাভাবিকতা ফিরে পাবে এমন কথা বলা হলেও তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আর মাত্র ছয় দিন পর শেষ হবে মার্চ মাস তবে পুঁজিবাজারে আশানুরূপ তেমন কিছুই প্রতিফলিত না হওয়ায় হতাশ বিনিয়োগকারীরা।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ২৮ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বলেন, পুঁজিবাজারে মার্চ মাস থেকে সুখবর আসবে বলে প্রত্যাশা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তবে তার সেই প্রত্যাশার কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বরং এমন ঘোষনা দেয়ার পরও থেমে নেই পতনের ধারা।
শিবলী রুবাইয়াত বলেছিলেন আইপিও মার্কেট ও বন্ড মার্কেটসহ সব মার্কেট ভালো চলছে। শুধু সেকেন্ডারি মার্কেটে সমস্যা। মার্চ মাস থেকে ব্যাংকগুলো ভালো ডিভিডেন্ড দিবে। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের হাজার হাজার কোটি টাকার সক্ষমতা বেড়ে যাবে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংকেরই এখনো ডিভিডেন্ড ঘোষণা আসেনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ডকে এক্সপোজার লিমিটেড বাইরে রাখবে। এর ফলে ব্যাংকগুলো নতুন করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। সব মিলিয়ে আগামী মার্চ মাস থেকে পুঁজিবাজার ভালো হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসা আর আগের মতো নেই। একই মার্কেট নিয়ে সবাই কাড়াকাড়ি করে। বাংলাদেশে যোগ্যতা থাকলে বিদেশের চেয়ে বেশি আয় করা যায়। বাংলাদেশে প্রচুর সুযোগ। এই মার্কেটে যদি এক টাকাও লাভ করতে পারেন তাহলে প্রতিদিন ১৭ কোটি টাকা লাভ করা যায়। ১০ পয়সা লাভ করলে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা প্রতিদিন লাভ করা সম্ভব। প্রতি বছর পার ক্যাপিটাল ইনকাম ও জিডিপি গ্রোথ হচ্ছে। ইউরোপের অর্ধেক দেশ থেকে আমাদের জিডিপির সাইজ বড়। মালয়েশিয়ার থেকে জিডিপির সাইজ অনেক বড়।
তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতিতে যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, তার প্রভাব শেয়ারবাজারেও পড়েছে। কয়েক দিনের টানা পতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এখন আতঙ্ক ভর করেছে। আবার ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশের পোর্টফোলির শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি বা ফোর্স সেলের আওতায় পড়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক কিছু বিনিয়োগকারীকে ঋণ সমন্বয়ের চিঠি দিয়েছে। ঋণ সমন্বয় করা না হলে পোর্টফোলিও থেকে কিছু শেয়ার বিক্রি করা হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের। একদিকে নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে, অন্যদিকে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের মধ্য থেকে বেড়েছে বিক্রির চাপ। দুই মিলে বাজার ছিল নিম্নমুখী।
জানতে চাইলে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘বর্তমানে শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বড় ধরনের নিষ্ক্রিয়তা রয়েছে। অর্থনীতিতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। তার প্রভাব ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর গিয়ে পড়েছে।
আমাদের পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আচরনটাই এমন যে দাম কমতে শুরু করলে অল্পতেই তারা আতঙ্কিত হয়ে বাছবিচার ছাড়া শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন। আবার যখন দাম বাড়তে থাকে, তখন আবার বাছবিচার ছাড়া শেয়ার কিনতে থাকেন। এ কারণে বড় ধরনের দরপতন শুরু হলে তখন সব শেয়ারের দামই কমে যায়।
এদিকে বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায় তিন কর্মদিবসে পতন আর দুই কর্মদিবস উত্থানের মধ্য দিয়ে গত এক সপ্তাহের লেনদেন শেষ করেছে দেশের পুঁজিবাজার। বিদায়ী সপ্তাহে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হওয়া অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। অপরদিকে যেসব কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে তার মধ্যে দাম বাড়ার বিপরীতে কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম। অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমায় কমেছে সূচক এবং লেনদেনও।
এর ফলে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসইর বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধন (পুঁজি) কমেছে ৪৮৩ কোটি ৭৩ লাখ ৮২ হাজার ৬০৭ টাকা। সাপ্তাহিক বাজার বিশ্লেষণে এ চিত্র দেখা গেছে। প্রায় একই চিত্র দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)।
রোববার (১৯ মার্চ) সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে লেনদেনের শুরুতে ডিএসইর মূলধন ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৮৯৪ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ১৬ টাকা। আর শেষ দিন বৃহস্পতিবার ২৩ মার্চ লেনদেন শেষে মূলধন দাঁড়ায় ৭ লাখ ৬১ হাজার ৪১০ কোটি ৯৩ লাখ ২১ হাজার ৪০৯ টাকা। অর্থাৎ টাকার অংকে পুঁজি কমেছে ৪৮৩ কোটি ৭৩ লাখ ৮২ হাজার ৬০৭ টাকা। এর আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ৩ হাজার ৬৯৬ কোটি ৯২ লাখ ৩ হাজার ৭৪ টাকা।
গেল সপ্তাহে মোট ৫ কর্মদিবসে লেনদেন হয়েছে। এসময়ে ডিএসইতে মোট ৩৮২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ৬৩টির, আর অপরিবর্তিত ছিল ২৬১টির। এর আগের সপ্তাহে লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছিল ১৫টির, কমেছিল ১৪১টির, আর অপরিবর্তিত ছিল ২২২টি কোম্পানির শেয়ারের দাম।
ফ্লোর প্রাইসের কারণে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়নি। এ কারণে লেনদেন হওয়া অধিকাংশ শেয়ারের দাম কমায় বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান সূচক আগের সপ্তাহের চেয়ে ৪ দশমিক ৯৪ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ২১৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
ডিএসইর অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসইএস সূচক ৩ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৩৫৩ পয়েন্টে ও ডিএস-৩০ সূচক আগের সপ্তাহের চেয়ে দশমিক ৭৪ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ২১৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৭৬২ কোটি ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৯ টাকা। এর আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৫৪০ কোটি ১০ লাখ ২৭ হাজার ৯৪০ টাকা। অর্থাৎ ৭৭৮ কোটি ৬ লাখ ৯৪ হাজার ২১১ টাকা লেনদেন কমেছে, শতাংশের হিসাবে ৩০ দশমিক ৬৩ শতাংশ কমেছে।
গত সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে রয়েল টিউলিপ সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের শেয়ার। এরপর যথাক্রমে লেনদেন হয়েছে রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার, ইস্টার্ন হাউজিং, শাইনপুকুর সিরামিক, আরডি ফুড লিমিটেড, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, জেনেক্স ইনফোসিস, এডিএন টেলিকম এবং আলহাজ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের শেয়ার।
দেশের অপর পুঁজিবাজার সিএসইতে লেনদেনে ছিল একই চিত্র। বিদায়ী সপ্তাহে সিএসইর সার্বিক সূচক ২২ পয়েন্ট বেড়ে ১৮ হাজার ৩৭৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এসময়ে লেনদেন হয়েছে ৬৪ কোটি ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৮৮৪ টাকা। এর আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ৫৭ কোটি ১৩ লাখ ৫৮ হাজার ৩১৮ টাকা। লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছে ৪২টির, কমেছে ৪৫টির আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১৮৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম।