অর্থনৈতিক মন্দায় তালিকাভুক্ত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে মুনাফায় ভাটা
শাহ আলম নূর : তালিকাভুক্ত শীর্ষ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মুনাফায় ভাটা। আর্থিকভাবে শক্তিশালী অবস্থা থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বড় মূলধনের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এসব কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় ১৩ বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে অধিকাংশের মুনাফায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।
সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন বেশিরভাগ তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলি (এমএনসি) ২০২২ সালে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির সম্মুখিন হয়েছে। কারন হিসেবে তারা বলছেন গত এক বছরে এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ যেমন বেড়েছে তেমনি বিশ্ববাজারে কাঁচামালের ঊর্ধ্বগতি এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারনে তারা ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে।
দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ১৩টি বহুজাতিক কোম্পানির রয়েছে। এর মধ্যে নয়টি কোম্পানি তাদের ২০২২ সালের আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করেছে।
আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশিত নয়টি বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে, চারটি কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে, বাকি পাঁচটি কোম্পানির মুনাফায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ এবং অন্যান্য ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক ভাবে। এতে এসব কোম্পানি ২০২২ সালে লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে।
এদিকে টাকার বিপরীতে ক্রমবর্ধমান ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারনেও এসব প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
রবির সিইও রাজীব শেঠি বলেন, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারনে টেলিকম কোম্পানির জন্য ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন করে তুলেছে। যা তাদের আর্থিক কর্মক্ষমতাকেও প্রভাবিত করেছে।
সিঙ্গার বাংলাদেশ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে যে, তাদের নিট মুনাফা ২০২১ সালে ছিল ৫১ কোটি টাকা ২০২২ সালে তাদের মুনাফা নেমে এসেছে ৭.৩ কোটি টাকায়। এমনকি ইলেকট্রনিক্স নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি গত ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম মুনাফা করেছে বলে জানানো হয়েছে।
কোম্পানিটি জানিয়েছে, গত এক বছরে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত ব্যয় এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তাদের মুনাফায় প্রভাব পড়েছে।
লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড, দেশের একটি মেডিকেল এবং শিল্প গ্যাস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। গত ছয় বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালে সর্বনিম্ন নিট মুনাফা অর্জন করেছে। কোম্পানিটি ২০২১ সালে ১২২.৫৮ কোটি টাকার মুনাফা করলেও ২০২২ সালে ২৮ শতাংশ কমে ৮৮.৩২ কোটি টাকার মুনাফা করেছে।
এদিকে, উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গত দুই বছরে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করা সত্ত্বেও, টাইলস, স্যানিটারিওয়্যার এবং চীনামাটির পণ্য উৎপাদনে নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান আরএকে সিরামিকস’র মুনাফা ২০২২ সালে সংকুচিত হয়েছে। উৎপাদন খরচ বিস্ময়কর ভাবে বৃদ্ধির কারণে এমন হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
২০২২ সালে কোম্পানির আরএকে সিরামিকসের নিট মুনাফা ২৫.৫ শতাংশের বেশি কমেছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সারা বছর তাদের একাধিক সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে। এর মধ্যে গ্যাসের ঘাটতি, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং অস্থিতিশীল মুদ্রা লেনদেনের কারণে উৎপাদনে ব্যপক প্রভাব পড়েছে। তালিকাভুক্ত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা আগের বছরের ৯০ কোটি টাকা থেকে কমে ২০২২ সালে ৬৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
সিরামিক শিল্প গ্যাসের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল, কারণ সিরামিক পণ্য উৎপাদনের জন্য উচ্চ প্রবাহের গ্যাস সরবরাহের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় সিরামিক শিল্প চাহিদা অনুসারে গ্যাস পাচ্ছে না বলে জানানো হয়েছে।
ডেটল এবং লাইসল জীবাণুনাশক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রেকিট বেনকিজার (বাংলাদেশ) গত এক বছরে তাদের মুনাফা ৬৫.৯১ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। যা আগের বছরের তুলনায় ১৮.৪৪ শতাংশ কম বলে জানানো হয়েছে। কোম্পানিটির ২০২১ সালে নিট মুনাফা ছিল ৮০.৮১ কোটি টাকা।
এছাড়াও, দেশের বৃহত্তম টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোন’র ২০২২ সালে নিট মুনাফা ১২.০৯ শতাংশ কমেছে। যদিও একই সময়ে তাদের আয় ৫.১২ শতাংশ বেড়েছে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা ২০২২ সালে ৩,০০৯ কোটি টাকায় নেমে আসে যা আগের বছর ৩,৪১২ কোটি টাকা ছিল।
রবি আজিয়াটা, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম টেলিকম অপারেটর, ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আগের বছরের তুলনায় কোম্পানির নিট মুনাফা ১.৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে, তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিটির আয় গত এক বছরে ৫.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৮,৫৮৬ টাকা। যা আগের বছর ছিল ৮,১৪২ কোটি টাকা।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশের কর-পরবর্তী মুনাফা আগের বছরের ১,৪৯৭ কোটি টাকা থেকে ১৯.৪ শতাংশ বেড়ে ১,৭৮৭ কোটি টাকা হয়েছে।
এছাড়া সিমেন্ট নির্মাতা লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড (এলএইচবিএল) জানিয়েছে যে ডিসেম্বরে সমাপ্ত বছরে তাদের শেয়ার প্রতি আয় দাঁড়িয়েছে ৩.৮৩ টাকা।