কোম্পানির পর্ষদ ভাঙায় নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা নিয়ে আপত্তি
সপ্তাহের ব্যবধানে পুঁজিবাজারে লেনদেন কমেছে ২৩ শতাংশ
শাহ আলম নূর : অর্থনৈতিক প্রতিবেদক : পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বর্তমানে চাইলেই বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কোনো কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে পারে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি) বিএসইসির এ এখতিয়ারের বিপক্ষে। বিএপিএলসি মনে করে, পর্ষদ ভাঙার ক্ষমতা থাকা উচিত একমাত্র আদালতের হাতে।
বিদ্যমান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দুটিকে মিলিয়ে একটি আইন করা হচ্ছে। নতুন করে প্রণয়ন করা হচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ২০২৩। ইতিমধ্যে এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, আইন লঙ্ঘনের কারণে কোনো ধরনের শুনানি ছাড়াই বিএসইসি কোনো কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করতে পারবে। তবে এ ব্যাপারে মতামত দিয়ে বিএপিএলসি বলেছে, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের এখতিয়ার থাকবে শুধু আদালতের হাতে। কমিশনের এ এখতিয়ার থাকা উচিত নয়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির বিকাশ এবং বিদ্যমান আইনে ‘পুঁজিবাজারের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন ধারা থাকার কারণেই’ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নতুন করে এ আইন করছে এবং ইতিমধ্যে একটি খসড়া তৈরি করেছে।
বিএপিএলসি সম্প্রতি বিদ্যমান আইনের নানা ত্রুটি চিহ্নিত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কাছেও চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে। পাঁচ পৃষ্ঠার এ চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন বিএপিএলসির সভাপতি এম আনিস উদ দৌলা।
ঠিক কী কী কারণে কোনো কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা যাবে, সে ব্যাপারে একটি নির্দিষ্ট তালিকা থাকা উচিত বলেও মনে করে বিএপিএলসি। কিন্তু খসড়া আইনে এ ধরনের কোনো ধারা রাখা হয়নি। সংগঠনটি বলেছে, শুনানির সুযোগ না দিয়ে কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা স্থগিত করা যাবে না। এতে পুঁজিবাজারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।
আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘনের জন্য কোনো ব্যক্তি শুধু লিখিত অভিযোগ নয়, মৌখিক অভিযোগও দিতে পারবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে খসড়া আইনে। বিএপিএলসি বলেছে, ব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানও যাতে অভিযোগ দিতে পারে, সেই ধারা যুক্ত করতে হবে। আর মৌখিক অভিযোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বলা আছে, একজন চেয়ারম্যান ও চারজন কমিশনার থাকবেন কমিশনে। এখনো তাই আছে। ১৯৯৩ সালের আইনে বেসরকারি খাত থেকে একজন কমিশনার নিয়োগের কথা বলা থাকলেও খসড়া আইনে তা বাদ পড়েছে বলে প্রশ্ন তুলেছে বিএপিএলসি। সংগঠনটি এ বিধান বহাল রাখা এবং চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের যোগ্যতার শর্ত হিসেবে ২০ বছরের অভিজ্ঞতার পরিবর্তে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা রাখার পক্ষে মত দিয়েছে।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কমিশন কোনো জরিমানা আরোপ করলে ২৫ শতাংশ অর্থ কমিশনের ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়ে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল বা মামলা দায়ের করা যাবে। বিএপিএলসি বলেছে, এ অঙ্ক ১০ শতাংশ করা হোক। নইলে কোম্পানিগুলো আইনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ হারাবে।
বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘বিদ্যমান অধ্যাদেশ ও আইন মিলিয়ে একটি আইন হওয়ার বিষয়ে কাজ চলছে। বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই তা করা হচ্ছে। খসড়া আইন তৈরি। এর ওপর অংশীজনদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। চূড়ান্ত খসড়া দাঁড় করাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগই। ফলে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি।
এদিকে বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায় তিন কর্মদিবস পতন আর দুই কর্মদিবস উত্থানের মধ্য দিয়ে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পার করেছে দেশের পুঁজিবাজার। এ সপ্তাহে যেসব কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে তার মধ্যে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে।
বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমার সপ্তাহেও দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধন (পুঁজি) বেড়েছে ১১৪ কোটি ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭৭৪ টাকা। সাপ্তাহিক বাজার বিশ্লেষণে এ চিত্র দেখা গেছে। প্রায় একই চিত্র দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)।
৯ এপ্রিল সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে লেনদেনের শুরুতে ডিএসইর মূলধন ছিল ৭ লাখ ৬২ হাজার ৯১১ কোটি ৯৮ লাখ ৫৬ হাজার ১৫১ টাকা। আর শেষ দিন বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে মূলধন দাঁড়ায় ৭ লাখ ৬৩ হাজার ২৬ কোটি ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৯২৫ টাকা। অর্থাৎ টাকার অংকে পুঁজি বেড়েছে ১১৪ কোটি ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭৭৪ টাকা।
গেল সপ্তাহে মোট পাঁচ কর্মদিবসে লেনদেন হয়েছে। এ সময়ে ডিএসইতে মোট ৩৭৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ৮৪টির, আর অপরিবর্তিত ছিল ২৩৮টির। এর আগের সপ্তাহে লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছিল ৭৬টির, কমেছিল ৫৮টির, আর অপরিবর্তিত ছিল ২৪৪টি কোম্পানির শেয়ারের দাম।
তাতে বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান সূচক আগের সপ্তাহের চেয়ে দশমিক ৯৮ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ২১৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
ডিএসইর অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসইএস সূচক দশমিক ৩৭ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৩৪৭ পয়েন্টে ও ডিএস-৩০ সূচক আগের সপ্তাহের চেয়ে ৩ দশমিক ৪ পয়েন্ট বেড়ে ২ হাজার ২০১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
এ সপ্তাহে ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ার লেনদেন হয়নি ২ শতাধিক কোম্পানির। এ কারণে লেনদেন হওয়া বড় বড় কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২৩৬ কোটি ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৫৯৮ টাকা। এর আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৮৯৩ কোটি ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ৮৮ টাকা। অর্থাৎ ৬৫৭ কোটি ২৬ লাখ ৪২ হাজার ২৮৭ টাকার শেয়ার লেনদেন কমেছে, শতাংশের হিসাবে ২২ দশমিক ৭২ শতাংশ কমেছে।
গত সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে আমরা নেটওয়ার্কসের শেয়ার। এরপর যথাক্রমে লেনদেন হয়েছে, জেনেক্স ইনফোসিস, জেমিনি সি ফুড, ইস্টার্ন হাউজিংয়ের শেয়ার, এপেক্স ফুটওয়্যার, রয়েল টিউলিপ সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেড, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, ইউনিক হোটেল, ওনিয়ন ইনফিউশন এবং অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রজ লিমিটেডের শেয়ার।
দেশের অপর পুঁজিবাজার সিএসইতে লেনদেনেও প্রায় একই চিত্র ছিল। বিদায়ী সপ্তাহে সিএসইর সার্বিক সূচক ২৭ পয়েন্ট বেড়ে ১৮ হাজার ৩৩১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে লেনদেন হয়েছে ৩৬ কোটি ১ লাখ ১৫ হাজার হাজার ৩৪৭ টাকা। এর আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ৩৯ কোটি ৬৩ লাখ ১৮ হাজার হাজার ৪১৯টাকা।
লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছে ৩৭টির, কমেছে ৫৬টির আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১৩৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম।