আজ: শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ইং, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

২৫ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার |

kidarkar

স্বর্ণ চোরাচালান শেষ পর্ব

বিমানযাত্রীরা এনেছেন ৪৫ হাজার কোটি টাকার সোনা

শাহ আলম নূর : বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসা বিমানযাত্রীদের হাত ধরে সোনা আসা বাড়ছে। ২০২২ সালে দুই বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় ৫৪ টন সোনা এসেছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। পরিমাণের দিক দিয়ে ২০২১ সালের তুলনায় গত বছর সোনা আসা বেড়েছে ৫৩ শতাংশ।
বিমানযাত্রীরা এসব সোনা এনেছেন বৈধ পথেই, যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ বিধিমালার আওতায়। তবে সোনা আনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসার ওপর প্রভাব পড়ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সোনার বদলে বিদেশফেরত ব্যক্তিরা বৈদেশিক মুদ্রা আনলে তা দেশের ব্যাংকব্যবস্থায় যুক্ত হতো। এই মুদ্রা বর্তমান সংকট কাটাতে ভূমিকা রাখত।
এই বিপুল পরিমাণ সোনার চাহিদা দেশে আছে কি না, সেই প্রশ্নও রয়েছে। স্বর্ণ নীতিমালা (২০১৮) অনুযায়ী, দেশে বছরে নতুন সোনার চাহিদা ১৮ থেকে ৩৬ টন। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) হিসাবে, বছরে ১৮ থেকে ২০ টন নতুন সোনা দরকার হয়।

এত সোনা দেশে আসার পর কী হয়, জানতে চাইলে বাজুসের সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, এই সোনার বেশির ভাগ পাচার হয়ে যায়। এক বছরে এত বেশি সোনা দেশে আসাটা অস্বাভাবিক। কারণ, দেশে এত সোনার চাহিদা নেই।
বাংলাদেশে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনা আনার হিসাবটি পাওয়া গেছে।
সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে ২০২১ সালের ছয় মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিলেট দিয়ে খুব বেশি সোনা আসে না।

কীভাবে, কেন আনা হয় সোনা :
যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ বিধিমালা অনুযায়ী, বিদেশ থেকে আসার সময় একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি সোনার বার শুল্ক-কর পরিশোধ করে আনতে পারেন। প্রতি ভরিতে শুল্ক-কর দিতে হয় দুই হাজার টাকা। সাধারণত দুটি বারেই ২৩৪ গ্রামের কাছাকাছি ওজন হয়।
বিনা শুল্কে যাত্রীরা ১০০ গ্রাম বা সাড়ে আট ভরি পর্যন্ত সোনার গয়না আনতে পারেন। এই গয়নার হিসাব কাস্টমস নথিভুক্ত করে না। ২০২২ সালে যে ৪৫ হাজার কোটি টাকার সোনা এসেছে, তার মধ্যে এই গয়না নেই।

মূল্যবান ধাতুর দাম ও অন্যান্য বিষয়ে তথ্যসেবা প্রদানকারী ওয়েবসাইট কিটকোতে দেখা যায়, বিশ্ববাজারে এখন প্রতি আউন্স সোনার দাম দুই হাজার ডলারের আশপাশে। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ভরির দাম পড়ে সাড়ে ৭৯ হাজার টাকা।
প্রতি ভরিতে দুই হাজার টাকা শুল্ক দেওয়ার পর দাম দাঁড়ায় সাড়ে ৮১ হাজার টাকার মতো। দেশের বাজারে এখন ২২ ক্যারেট মানের সোনার ভরি ৯৮ হাজার ৪৪৪ টাকা। কলকাতার বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে এখন ২৪ ক্যারেটের পাকা সোনার ভরি ৭১ হাজার ১৫০ রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৯২ হাজার টাকা দাঁড়ায়।
দুই বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে যাত্রীদের হাত ধরে সোনার বেশির ভাগই আসছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। কোনো কোনো যাত্রী নিজে থেকেই সোনার বার নিয়ে আসেন। অনেক সময় সোনা পাচারকারীর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশগামী যাত্রীদের বৈধ পথে দুটি সোনার বার বহন করার জন্য অর্থ দেন। বিমানবন্দরে শুল্ক পরিশোধ করার পর যাত্রীদের কাছ থেকে তা নিয়ে নেওয়া হয়। ঝুঁকি না থাকা এবং আয়ের সুযোগ থাকায় যাত্রীরা সোনা বহনে আগ্রহ দেখান।

বাড়ছে কেন
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সোনা আনা বাড়ছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুল্ক কমানোর পর। ওই অর্থবছরে যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ বিধিমালার আওতায় সোনা আনার ক্ষেত্রে ভরিপ্রতি শুল্ক এক হাজার টাকা কমিয়ে দুই হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
দুই বিমানবন্দরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালে সাড়ে ৫ টন, ২০২১ সালে ৩৫ টন ও ২০২২ সালে প্রায় ৫৪ টন সোনা এসেছে। উল্লেখ্য, ৫৪ টনে প্রায় ৪৬ লাখ ভরি হয়।
২০২০ সালে অবশ্য করোনার কারণে উড়োজাহাজে যাত্রী পরিবহন কম হয়েছিল। ওই বছর ২৩ হাজার ৬৭৪ জন, ২০২১ সালে ১ লাখ ৫১ হাজার ৯১৭ জন ও ২০২২ সালে প্রায় ২ লাখ ৩২ হাজার জন যাত্রী সোনা এনেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন সোনা মজুত আছে ১৪ টন। দেখা যাচ্ছে, এর চেয়ে অনেক বেশি সোনা চলে আসছে যাত্রীদের হাত ধরে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল ২০১৭ সালে ভারতের সোনার বাজারবিষয়ক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ভারতের সরকার সোনা আমদানি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার পর ২০১৩ সাল থেকে অবৈধ পথে দেশটিতে সোনা পাচার বাড়তে থাকে। প্রতিবছর ১০০ টনের মতো সোনা পাচার হয় ভারতে। এর উৎস বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন। ২০২১ সালের প্রতিবেদনেও মিয়ানমার ও চীনের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা পাচারের কথা উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।

প্রাতিষ্ঠানিক আমদানি নগণ্য
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও সোনা আমদানি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে সোনা আমদানির ডিলার হিসেবে লাইসেন্স দিয়েছে। যদিও তাদের আমদানির পরিমাণ কম।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, লাইসেন্স পাওয়ার পর ২০২০ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৮২ লাখ ডলার ব্যয় করে সাতটি প্রতিষ্ঠান ১৩৯ কেজি ৬৪০ গ্রাম ওজনের সোনার বার আমদানি করেছে। ১২টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেয়েও আমদানি করেনি। ২০২২ সালে মোট ২৪ কেজি সোনা আমদানি হয়, যা আগের বছর ছিল ৯৩ কেজি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক আমদানি কম হওয়ার কারণ এ ক্ষেত্রে শুল্ক-কর বেশি। যাত্রীরা ভরিতে দুই হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে সোনা আনতে পারেন। ব্যবসায়ীদের দিতে হয় প্রায় পাঁচ হাজার টাকা।
চাহিদার তুলনায় সোনার বার আমদানি বেশি হওয়ায় বিষয়টি অনুসন্ধান করা দরকার বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, দেশে ভালো দাম পাওয়ায় বিদেশ থেকে যাত্রীদের মাধ্যমে সোনা আসছে। আবার প্রতিবেশী দেশে দাম বেশি থাকলে পাচারও হতে পারে।
তিনি বলেন, আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে শুল্কহারে সামঞ্জস্য এনে যেমন সোনা পাচার ঠেকানো সম্ভব, তেমনি যাত্রীপ্রতি সোনা আনার পরিমাণ আরেকটু কমানো যেতে পারে। কমানো হলেও প্রবাসীদের জন্য সুযোগ থাকবে। কিন্তু সোনা পাচারের প্রবণতা কমবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে এখন এসব পদক্ষেপ কাজে লাগতে পারে।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.