আজ: বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ইং, ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

০৮ জুন ২০২৩, বৃহস্পতিবার |

kidarkar

তীব্র দাবানল: স্বাস্থ্যঝুঁকিতে কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের ১০ কোটির বেশি মানুষ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কানাডার দাবানল নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ভয়াবহ এই দাবানলের কারণে কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১০ কোটির বেশি মানুষ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে তার দেশ।

কানাডিয়ান ন্যাশনাল ফায়ার ডেটাবেস অনুসারে, ৩৮ লাখ হেক্টরের বেশি অর্থাৎ নিউ জার্সির প্রায় দ্বিগুণ এলাকা এখন পর্যন্ত পুড়ে গেছে। যা বছরের এই সময়ে গত ১০ বছরে হওয়া গড় দাবানলের তুলনায় ১২গুন বেশি।

দাবানলের কারণে কানাডায় ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এছাড়া কুইবেকে ১৫০টি এলাকায় সক্রিয় দাবানলের কারণে নিউইয়র্কের বায়ু দূষণ বাড়ছে। বুধবার বিকেল পর্যন্ত নিউইয়র্ক সিটি বায়ু দূষণে শীর্ষ অবস্থানে ছিল।

এদিকে দাবানল পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বুধবার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর সঙ্গে কথা বলেছেন। বিধ্বংসী এই দাবানল মোকাবিলায় অতিরিক্ত সহায়তা দেওয়ারও প্রস্তাব দেন তিনি। পরবর্তীতে এক টুইট বার্তায় বাইডেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রুডো বলেন, এই আগুন প্রতিদিনের জীবন-জীবিকা এবং আমাদের বায়ুর মানকে প্রভাবিত করছে। দাবানলের কারণে বাতাসের মান খারাপ হওয়ায় উত্তর আমেরিকার লাখ লাখ মানুষকে ঘরের বাইরে এন৯৫ মাস্ক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার থেকে নিউইয়র্কে বিনা পয়সায় মাস্ক বিতরণ করা শুরু হবে। কর্মকর্তা বলেছেন, বিপজ্জনক এই ধোঁয়াটে অবস্থা পুরো সপ্তাহ ধরে চলতে পারে। বেশিরভাগ ধোঁয়া আসছে কুইবেক থেকে। সেখানে দেড় শতাধিক এলাকায় আগুন জ্বলছে।

বুধবার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রদেশটির ১৫ হাজারের বেশি বাসিন্দাকে সরিয়ে নিতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ আগুনের মৌসুমে পরিণত হয়েছে এবারের দাবানল পরিস্থিতি।

নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হচুল বলেন, বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের মধ্যে ১০ লাখ মাস্ক বিতরণ করা হবে।এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এটা একটা সাময়িক অবস্থা। এটা কোভিড নয়। তিনি আরও বলেন, নিউইয়র্ক শহরের বাস এবং ট্রেনে উচ্চ মানসম্পন্ন বাতাস পরিশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে যার কারণে এগুলো নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করে।

কানাডার পরিবেশ বিভাগ বলছে, বৃহস্পতিবার টরেন্টোর অবস্থা আরও খারাপ হবে। কারণ আরো বেশি ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়বে। বৃধবার এক বিশেষ আবহাওয়া বুলেটিনে সংস্থাটি বাইরে থাকা সবাইকে মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছে।

এক বিবৃতিতে কানাডার পরিবেশ বিভাগ জানায়, এই ক্ষুদ্র উপাদানগুলো সাধারণত স্বাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাতাসের মানকে শ্বাসযন্ত্রের রোগে ভুগছেন এমন বাসিন্দাদের জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে ঘোষণা করেছে।

সব মিলিয়ে উত্তর আমেরিকার লাখ লাখ মানুষ দূষিত বাতাসের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সতর্ক করা হয়েছে। অপরদিকে নিউইয়র্কে কমলা রঙের কুয়াশা শহরের আকাশসীমাকে ঢেকে দিয়েছে। এছাড়া স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো উল্লেখযোগ্য স্থাপনাগুলোও এতে ঢেকে গেছে।

বুধবার মেয়র এরিক অ্যাডামস বলেন, আমরা নিউইয়র্ক বাসীকে আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন যতটা সম্ভব বাইরের কাজকর্ম কমিয়ে ফেলেন। নিউইয়র্কে চিড়িয়াখানায় পশুদেরকে ঘরের মধ্যে আনা হয়েছে এবং ঘোড়ায় টানা গাড়ির চলাচল বন্ধ রয়েছে। বুধবার ওয়াশিংটন ডিসির স্কুলগুলোতে সব ধরণের বাইরের কর্মকাণ্ড বাতিল করা হয়েছে। সেখানে বাতাসের মান ‘কোড রেড’ ঘোষণা করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা লোকজনকে বাইরে শরীরচর্চা করতে নিষেধ করেছেন এবং যত কম সম্ভব ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। এই ধোঁয়া তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। কানাডার কর্মকর্তারা বলছেন, দেশটিতে সবচেয়ে খারাপ দাবানলের মৌসুম রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে। এর পেছনে তুলনামূলক বেশি গরম ও শুষ্ক বসন্তকালকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই অবস্থা গ্রীষ্মকাল জুড়েও অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বুধবার হোয়াইট হাউস জানিয়েছে যে, দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় কর্মকর্তাদের সহায়তা করতে ৬০০’র বেশি দমকল কর্মীকে কানাডায় পাঠানো হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে যা দাবানলকে আরও তীব্র করবে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শিল্পযুগের তুলনায় এরইমধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। আর বিশ্বজুড়ে সরকার প্রধানরা কার্বন নিঃসরণের হার না কমালে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।

কানাডায় দাবানলের কারণে সীমিত দৃষ্টিসীমা তৈরি হওয়ার কারণে নিউইয়র্কের প্রধান প্রধান বিমানবন্দরগুলোতে ফ্লাইট বিলম্বিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ভ্রমণকারীদের সতর্ক করে বলেছে যে, নিউইয়র্কের লাগার্ডিয়া এবং পাশের নেওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট দুই ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্ব হতে পারে।

ফ্লাইট অ্যাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী, নিউইয়র্ক সিটি এয়ারপোর্টে প্রায় ৮০০ ফ্লাইট বিলম্বিত হয়েছে। দুই দেশেই লাখ লাখ মানুষ বাতাসের মান সম্পর্কিত হুঁশিয়ারির আওতায় রয়েছে। বিমান চলাচল বিলম্বিত করার আরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। আটলান্টা থেকে হিউস্টনের ফ্লাইটও বিলম্বিত হয়েছে। একই সঙ্গে ফিলাডেলফিয়ার প্রধান বিমানবন্দরের আগমনী ফ্লাইটও বিলম্বিত হয়েছে।

টরেন্টোর পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের প্রায় ২৫০ ফ্লাইট বিলম্বিত হয়েছে। এছাড়া নিউইয়ক শহরের লাগার্ডিয়া বিমানবন্দর যাত্রীদের বলেছে, আবহাওয়ার খারাপ অবস্থা এডিএ বিমানবন্দরে ফ্লাইটের উপর প্রভাব ফেলেছে। ফ্লাইটের অবস্থা জানতে এয়ারলাইন্সের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

কানাডার দমকলবাহিনী দেশজুড়ে শুরু হওয়া ৪০০টির মতো দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পাচ্ছে, দেশটির পূর্বাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা এবং পূর্ব উপকূল ধোঁয়ার চাদরে ঢেকে গেছে। বাতাসের মান ও দূষণ নিয়ে দুই দেশের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাই হুঁশিয়ারি জারি করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাবানলের ধোঁয়া দীর্ঘমেয়াদে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সেন্টার অব আরবান এনভায়রনমেন্ট নামে একটি সংস্থার পরিচালক এবং ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর অধ্যাপক ম্যাথিউ অ্যাডামস বলেন, দাবানলের ধোঁয়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে প্রবেশ করলে তাৎক্ষণিকভাবে শ্বাসকষ্ট, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, বুকে ব্যথা হওয়া কিংবা চোখ, নাক এবং গলায় জ্বালাপোড়া দেখা দেয়।

অধ্যাপক অ্যাডামস বলেন, বাতাসের এই দূষণের সময়টাতে আমরা হাসপাতালে রোগীর ভিড় দেখবো। আর যারা এই সময়ে হাসপাতালে আসবে তাদের আগে থেকেই শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা থাকবে। কিন্তু দাবানলের ধোঁয়ায় আরও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে যেমন ক্যান্সার বা ফুসফুসের রোগ, বিশেষ করে যারা ওই এলাকার বাসিন্দা এবং প্রায়ই দাবানলের শিকার হয়।

ধোঁয়ার কুয়াশায় যে ক্ষুদ্র কণা থাকে সেগুলোর মাধ্যমেই এই সমস্যা তৈরি হয়। তিনি বলেন, এগুলো রক্ত এবং দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গে মিশে যায় এবং এর কারণে ডিএনএ-তে পরিবর্তন হয় এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

অধ্যাপক অ্যাডামস আরও বলেন, অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, দীর্ঘ সময় ধরে দাবানলের আগুনের ধোঁয়ার সংস্পর্শে থাকলে তা গর্ভবতী নারী ও তার গর্ভের সন্তানের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এটা নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঘরে থাকুন এবং এর সংস্পর্শে কম আসুন।

কিন্তু যেসব এলাকা দাবানলের আশেপাশে, সেখানকার বাসিন্দাদের বাইরে বের হওয়ার সময় এন৯৫ মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক অ্যাডামস।

সূত্র: বিবিসি, এনডিটিভি

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.