খেলাপির সিংহভাগই ১০ ব্যাংকে
নিজস্ব প্রতিবেদক: আএমএফের শর্ত এবং ঋণ খেলাপিদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণ কমছে না। বরং ব্যাংক খাতের ‘প্রধান সমস্যা’ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সবশেষ তথ্যমতে, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। যদিও এটা কাগজে-কলমে, বাস্তবে এর চেয়ে আরও বেশি বলে ধারণা এ খাতের বিশেষজ্ঞদের। করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণকে দেশের ব্যাংক খাতের বড় দুই সমস্যা বলছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। আর এক বছরে বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। তবে অর্ধেকের বেশি খেলাপি ঋণই মাত্র ১০ ব্যাংকের। দেশে কার্যক্রম চালানো ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ১০ ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ ৮১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৬২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। বিতরণ করা এই ঋণের ৫৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা খেলাপি। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংক ১১ লাখ ৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা।
গত বছরের (২০২২ সালের) মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। এছাড়া গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৫৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ চলতি বছরের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা।
মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের মধ্যে ৬২ শতাংশই ১০ ব্যাংকের। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৮১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ৯৪৩ কোটি। এছাড়া জনতা ব্যাংকের খেলাপি ১৪ হাজার ৮৮৭ কোটি, সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ১২ হাজার ছয় কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে খেলাপি ৭ হাজার ৭৭৩ কোটি, রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি, বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ৬ হাজার ১০১ কোটি, এবি ব্যাংকের খেলাপি ৪ হাজার ৬৯ কোটি, পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৪২৭ কোটি এবং বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২০৯ কোটি টাকায়।
ব্যাংকের মতো ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। দেশে কার্যক্রম চালানো ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৩টির খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মোট ঋণস্থিতি ৭০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ নিয়ে সম্প্রতি এক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা। পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নৈতিকতার অনুশীলন প্রয়োগ করতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের আরও ভূমিকা রাখতে হবে।
ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, খেলাপি ঋণ কমানোর ক্ষেত্রে সফলতা আসছে না। খেলাপি ঋণ আদায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে, ঋণ আদায়ে সময় বেঁধে দিতে হবে। সে সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে কমাতে হবে খেলাপি ঋণ। না পারলে সেসব ব্যাংকের শাখা বন্ধের নির্দেশ দিতে হবে। কঠোরভাবে এটা তদারকি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকের দুর্বলতাও দেখতে হবে। সেখানে মাত্র কয়েকজনের সমস্যা থাকতেই পারে। তাই বলে ঢালাওভাবে খেলাপিতে ছাড় কেন!