আজ: রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ইং, ৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

২২ জুলাই ২০২৩, শনিবার |

kidarkar

দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে রমরমা ব্যবসা!

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, যার দখলে রয়েছে দেশের ওষুধের বাজারের প্রায় ২০ শতাংশ। দেশের সেরা মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন পুঁজিবাজারের শীর্ষ বাজার মূলধনি কোম্পানি। বাংলাদেশের সেরা মৌলভিত্তির এসব কোম্পানি নিজ নিজ খাতে শীর্ষে থাকলেও পুঁজিবাজারে তাদের অবস্থান তলানিতে। দীর্ঘদিন ধরে এসব শেয়ারের তেমন কোনো লেনদেন নেই। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী এসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে আটকে গেছেন। তবে স্বল্প মূলধনি, দুর্বল মৌলভিত্তির লোকসানি ও উৎপাদন বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারের রমরমা অবস্থা। পুঁজিবাজারে এখন এসব কোম্পানিই দরবৃদ্ধি ও লেনদেনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এতে করে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার পরিণত হয়েছে মন্দ শেয়ারের বাজারে।

বাজারের এমন পরিস্থিতির জন্য ফ্লোর প্রাইসকে দায়ী করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা। গত বছর দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর থেকেই ধীরে ধীরে মৌলভিত্তি ও বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেন কমে যায়। একপর্যায়ে কোনো ক্রেতাই খুঁজে পাওয়া যায়নি এসব শেয়ারে। এ কারণেই এসব শেয়ারে আটকে থাকা লাখ লাখ বিনিয়োগকারী চাইলেও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। মূলত ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীদের উল্লেখযোগ্য অংশ সাইড লাইনে ফিরে যাওয়ায় ভালো শেয়ারে ক্রেতাসংকট তৈরি হয়েছে। মুনাফা খুঁজতে এসব বিনিয়োগকারী এখন মন্দ শেয়ারের দিকে ঝুঁকেছেন। এতে করে মন্দ শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়ে পুঁজিবাজারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সর্বশেষ কার্যদিবস গত বৃহস্পতিবার মাত্র ৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে গ্রামীণফোনের। হাজার হাজার বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করতে চাইলেও কোনো ক্রেতা না থাকায় বিক্রি হয়নি। গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে কোম্পানিটির শেয়ারের দর ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। একই পরিস্থিতি স্কয়ার ফার্মার ক্ষেত্রেও। মাত্র ৩২ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি হয়েছে সেদিন। গত বছরের ৩০ নভেম্বরের পর থেকে শেয়ারটির দর একই জায়গায় আটকে আছে। সর্বশেষ কার্যদিবসে ওষুধ খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি রেনেটা লিমিটেডের মাত্র ৬৪ হাজার টাকার শেয়ার বিক্রি হয়েছে। উচ্চ মুনাফার এ কোম্পানিটির শেয়ার দরও আটকে গত ১৩ নভেম্বর থেকে। দেশীয় ইলেকট্রনিক জায়ান্ট ওয়ালটনের মাত্র ৫টি শেয়ার বিক্রি হয়েছে সেদিন। এর বাইরে ইউনাইটেড পাওয়ার, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলসহ দেশীয় সেরা কোম্পানিগুলোর শেয়ার চাইলেও কেউ বিক্রি করতে পারছেন না। বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেঙ্কিজার, ম্যারিকো, ইউনিলিভার, বার্জারের শেয়ারেও কারও আগ্রহ নেই।

বিপরীতে ফু-ওয়াং ফুডের মতো দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ার কয়েক দিন ধরে ডিএসইর লেনদেনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। গত চার কার্যদিবস ধরে ডিএসইর দৈনিক লেনদেনের ৮ থেকে ১০ শতাংশ আসছে এই কোম্পানি থেকে। গত সপ্তাহে ২০৮ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি হয়েছে এই কোম্পানির। কারসাজিকারকদের কল্যাণে গত চার কার্যদিবসে শেয়ারটির দর বেড়েছে ৩৬ শতাংশ।

উৎপাদন বন্ধ থাকা লোকসানি প্রতিষ্ঠান খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ নামের কোম্পানিটির দর গত আড়াই মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ১৬০ শতাংশ বেড়েছে। গত ৩০ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ১০ টাকা ৪০ পয়সা, যা গত বৃহস্পতিবার ২৭ টাকা ১০ পয়সা সর্বশেষ কেনাবেচা হয়েছে। গত সপ্তাহে শেয়ারটির দর বেড়েছে প্রায় ৩৯ শতাংশ। এ সময় কোম্পানিটির প্রায় শতকোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে।

লোকসানি আরেক প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড। দীর্ঘদিন ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকার পর গত ২০ জুন থেকে হঠাৎ করেই শেয়ারটির দর বাড়তে শুরু করেছে। মাত্র ৯ কার্যদিবসে শেয়ারটির দর ৮৩ শতাংশ বেড়েছে। দরবৃদ্ধির পাশাপাশি লেনদেনের শীর্ষ তালিকায়ও রয়েছে দুর্বল মৌলভিত্তির এ কোম্পানির শেয়ার।

হিসাব বছরের নয় মাসে মাত্র ১ পয়সা শেয়ারপ্রতি আয় থাকা কোম্পানি ঢাকা ডায়িংয়ের শেয়ার দরও ঊর্ধ্বমুখী ধারায়। গত পাঁচ কার্যদিবসে শেয়ারটির দর বেড়েছে ২১ শতাংশের বেশি। শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়ে কোম্পানিটি ‘বি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে। এর বাইরে জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস, ফু-ওয়াং সিরামিক, মোজাফ্ফর হোসেন স্পিনিং মিলস, আলিফ ম্যানুফ্যাকচারিং, সিমটেক্স, কেয়া কসমেটিক্সসহ দুর্বল মৌলভিত্তির অন্য সব কোম্পানির শেয়ার দেদার লেনদেন হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাজারে সূচকের পতন ঠেকাতে গত বছরের ২৯ জুলাই দ্বিতীয়বারের মতো তালিকাভুক্ত সব শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ওপর ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যস্তর আরোপ করে বিএসইসি। ওই সময় এসইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সর্বনিম্ন মূল্যস্তর হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের দামের একটি নির্ধারিত সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ফলে বাজারমূল্য ওই বেঁধে দেওয়া দামের নিচে নামার কোনো সুযোগ নেই। বাজারের পতন ঠেকাতে এভাবেই কৃত্রিমভাবে শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের দাম ধরে রেখেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তবে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে বললেও প্রায় এক বছর ধরে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে রেখেছে বিএসইসি।

এর আগে দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে পুঁজিবাজারে ধস নামলে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ সব শেয়ারের দরে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছিল বিএসইসি। তখনো এক বছরের বেশি সময় ফ্লোর প্রাইস ধরে রাখে এসইসি। পরে ধাপে ধাপে তা প্রত্যাহার করে নেয়। দ্বিতীয়বার ফ্লোর প্রাইস আরোপের প্রায় পাঁচ মাস পর গত ২১ ডিসেম্বর প্রাথমিকভাবে স্বল্প মূলধনি ১৬৯ কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলেও পরে আবারও তা আরোপ করা হয়।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, দেশের পুঁজিবাজারের পলিসি ভুলভাবে করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারের লেনদেন না হওয়ার জন্য দায়ী ফ্লোর প্রাইস। এটা তুলে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো সাময়িকভাবে কিছু পতন হবে, তবে আবার তা ঠিকও হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের এখানে দীর্ঘদিন ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে রাখা হয়েছে। ফলে কেউ চাইলেও ভালো মৌলভিত্তির শেয়ার বিক্রি করে আরেকটি শেয়ারে বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন না।

তিনি আরও বলেন, শেয়ার দরের ওঠানামাই হচ্ছে পুঁজিবাজারের বৈশিষ্ট্য। ফ্লোর প্রাইস আরোপের মাধ্যমে বাজারের এই বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এর কারণে স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনও বাড়ছে না। ভালো শেয়ারগুলোর লেনদেনের সুযোগ তৈরি হলে এত দিনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন ৩ হাজার কোটি টাকা হতো। কিন্তু সেটি হচ্ছে না; বরং ফ্লোর প্রাইসের কারণে শুধ জুয়াড়িরা সুযোগ পাচ্ছে। স্বল্প মূলধনি ও দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করছে।

বাজারসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মৌলভিত্তির শেয়ারগুলোতে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশিরাও আটকে গেছেন। ২০১৮ সালের পর থেকেই বিদেশিরা ধাপে ধাপে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। তবে করোনার পর ২০২০ সালের পর থেকে চাইলেও তারা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে ফ্লোর প্রাইস বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশের টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন শুরু হলে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়। তবে কাক্সিক্ষত ক্রেতা না থাকায় শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে পারছে না বিদেশিরা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে ১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার প্রত্যাহার করে নেয়। তবে পরে ফ্লোর প্রাইসের কারণে বিনিয়োগ প্রত্যাহার কমে গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে পেরেছে তারা।

ইউক্রেনের যুদ্ধের পর গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে বিদেশিদের বিপুল পরিমাণের লোকসান গুনতে হয়েছে।

বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, ‘সারা বিশ্বে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়েছিল, যাতে বিনিয়োগকারীদের পুঁজির সুরক্ষা দেওয়া যায়। এখনো কিন্তু সেই পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। ফ্লোর প্রাইস নিয়ে আমরাও বিভিন্ন চাপের মুখে রয়েছি। কিন্তু এটা তুলে দিলে প্যানিক তৈরি হবে, মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাবে। কিন্তু এটা আমরা চাই না।’

বিএসইসির চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘বাজার আরেকটু ভালো হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি আমরা। ইতিমধ্যেই বিদেশিরা আসতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি ২-৩টি বড় লেনদেন হয়েছে বিদেশিদের। সূচকেও কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে। বাজার পরিস্থিতি একটু ভালোর দিকে গেলেই যত শিগগির সম্ভব ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হবে।’

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর সাময়িক ঊর্ধ্বগতি দেখা দিলেও গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচকে নিম্নমুখী ধারা তৈরি হয়। তিন মাসে প্রায় ৪২৩ পয়েন্ট সূচক হারায়। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ার দরের ওঠানামা বন্ধ হয়ে গেলে সূচক স্থবির হয়ে পড়ে। তবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে স্থবিরতা দেখা দিলেও চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্বের উন্নত দেশের পুঁজিবাজার ইউক্রেনের যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে এখন চাঙ্গা অবস্থায় রয়েছে। গত ছয় মাসে টানা ঊর্ধ্বমুখী ধারায় থাকার কারণে ভারতীয় পুঁজিবাজারের সূচক সেনসেক্স এখন সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। গত এক বছরে সূচকটি বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। এ সময়ে জাপানের জেপি২২৫ সূচকটি বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালস্ট্রিট ছাড়াও ইউরোপের বেশিরভাগ সূচক এ সময়ে ঊর্ধ্বগতিতে রয়েছে।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.