আজ: শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ইং, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার |

kidarkar

বাংলাদেশের স্টার্টআপে বিদেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগ কমছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগে অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে। তাই অন্তত বিনিয়োগকারীদের সন্তুষ্ট করার জন্য বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলোকে নিট মুনাফায় নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করা হচ্ছে।

‘চালডাল’ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল স্টার্টআপগুলির মধ্যে একটি। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৩২.৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে এই কোম্পানি।

কিন্তু বৈশ্বিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি) বিনিয়োগকারীরা মন্দাভাবে সতর্ক হয়ে ব্যয়ের বিষয়ে আরো হিসেবি হয়ে ওঠায় বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলি নতুন তহবিল সংগ্রহের জন্য লড়াই করছে, এমনকি চালডালের মতো প্রতিশ্রুতিশীল স্টার্টআপগুলিও তহবিলের সংকট থেকে নিরাপদ নয়।

করোনা মহামারি চলাকালীন অর্ডার বেড়ে যায় চালডাল-এর। এসময় প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, যশোর, গাজীপুর, রাজশাহী, টাঙ্গাইল এবং নারায়ণগঞ্জের তাদের ব্যবসা প্রসারিত করে।

চালডাল ‘ডার্ক স্টোর’ মডেল অনুসরণ করে। খুচরা দোকানের পরিবর্তে নিজস্ব গুদাম থেকে অর্ডারকৃত পণ্য সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। সুতরাং নতুন শহরে সম্প্রসারণের অর্থ হলো পণ্য মজুদে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা নিশ্চিত করা।

২০২২ সালে কোম্পানিটি বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর এবং কুমিল্লাসহ ১১টি শহরে নিজেদের কার্যক্রম চালুর পরিকল্পনা করে।

কিন্তু মাঝপথেই এসব কার্যক্রম বন্ধ করা হয়, পাশপাশি চলতি বছরের শুরুতে সিলেট, রাজশাহী এবং গাজীপুরের তাদের সেবা বন্ধ করা হয়।

চালডাল-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াসিম আলিম বলেন, তহবিল সংকটের ফলে সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘এখন সম্প্রসারণের সঠিক সময়, কিন্তু নগদ অর্থ হলো অক্সিজেনের মতো, যার অভাবে আপনি দ্রুত দৌড়াতে পারবেন না।’

চালডাল আট দফা তহবিল সংগ্রহ করেছে। মহামারী চলাকালীন ১৮ মিলিয়ন ডলারের বেশি তহবিল এসেছে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে, চালডাল তার তহবিল সংগ্রহের ‘সিরিজ সি রাউন্ড’ বন্ধ করে দেয়। যখন কোন প্রতিষ্ঠান বাজারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে, তখন সম্প্রসারণের জন্য বা অন্য প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণে বড় বিনিয়োগ পেতে ‘সিরিজ সি রাউন্ড’ চালু করে তহবিল সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে চালডাল-এ বিনিয়োগে মাঝারি পর্যায়ের আগ্রহ দেখা গেছে। ১৩ মিলিয়ন বিনিয়োগ আসে, যা কমবেশি সিরিজ বি রাউন্ডের সমান।

উদাহরণস্বরূপ আরেক স্টার্টআপ ‘শপআপ’ ভালার ভেঞ্চার, প্রসাস, সিকোইয়া ক্যাপিটাল, ফ্লোরিশ ভেঞ্চারস, টাইগার গ্লোবালের মতো বিখ্যাত বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২০১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ সংগ্রহ করে।

চলতি বছর শপআপ সংগ্রহ করেছে ৩০ মিলিয়ন। যা বাংলাদেশি সব স্টার্টআপের পাওয়া বিনিয়োগের ৬৪ শতাংশ। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো পুরো অর্থই এসেছে ঋণ হিসেবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডিং নয়।

বছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিক শেষ হতে আর এক মাস বাকি, এরমধ্যে বাংলাদেশি স্টার্টআপগুলো কেবল ৪৭ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে। গত বছর প্রথম ৯ মাসে সংগ্রহ ছিল ১১৪ মিলিয়ন। আর পুরো ২০২২ সালে বিনিয়োগ আসে ১২৫ মিলিয়ন ডলার।

স্টার্টআপ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থাগুলি এখন কম নগদ অর্থ ব্যয় করে দ্রুত ব্যবসা বাড়ানো যায় এবং আয় করা যায় এমন স্টার্টআপে আগ্রহী।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে এই মুহূর্তে তিনটি প্রধান সমস্যা রয়েছে: যে সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে তা যথেষ্ট বড় নয়; সরবরাহ করা সমাধানগুলিও যথেষ্ট নয় এবং দুর্বল নেতৃত্ব।

তাই সাফল্য পাওয়া এবং স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানকে বড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

আইডিএলসি ফাইন্যান্স বর্তমানে ৪৫ কোটি টাকার ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ জাভেদ নূর বলেন, বিনিয়োগ সংকট অনিবার্য।

‘এর কারণ হলো স্টার্টআপ এবং তাদের বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির ভ্যালুয়েশন (বর্তমান মূল্য) এবং নিট মুনাফার চেয়ে মোট বিক্রির পরিমাণের পিছে ছুটছে।’

চালডাল-এর সিইও ওয়াসিম উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের একটি সমস্যা হল স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা পরিষেবাকে মূল্য দেয় না; তারা সম্পদকে মূল্য দেয়। উদাহরণস্বরূপ ‘বিকাশ’ এর কথা চিন্তা করুন। কোম্পানিটি দেশের জন্য বিশাল মূল্য তৈরি করেছে। কিন্তু ঐতিহ্যগত অর্থে বিকাশের কত সম্পদ আছে?

২০২৩ সাল স্টার্টআপগুলির জন্য ভালো যাচ্ছে না। ২০২৩ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বৈশ্বিক ভেঞ্চার ফান্ডিং ১৮ শতাংশ কমে ৬৫ বিলিয়ন হয়েছে। ক্রাঞ্চবেস অনুসারে, গত বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায় ৪৯ শতাংশ বিনিয়োগ কমেছে। গতবছর একই সময়ে বিনিয়োগ হয়েছিল ১২৭ বিলিয়ন ডলার।

অর্ধবার্ষিকী হিসেবেও বিনিয়োগ কমেছে। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে বিনিয়োগ ৫১ শতাংশ কমে হয়েছে ১৪৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২২২ সালে একই সময় বিনিয়োগ হয় ২৯৩ বিলিয়ন ডলার।

এশিয়াতে এই বছরের প্রথমার্ধে স্টার্টআপের জন্য তহবিল আগের বছরের তুলনায় ৫০% কমেছে। ২০২২ সালের প্রথমার্ধে ৭৩ বিলিয়ন থেকে কমে এই বছর হয়েছে ৩৬.৩ বিলিয়ন ডলার।

ক্রাঞ্চবেস এর তথ্য অনুযায়ী, বিনিয়োগ চুক্তির পরিমাণও কমেছে। ২০২২ সালের প্রথমার্থে চুক্তি হয়েছিল ৫,৪০২টি। এ বছর তা ৪০ শতাংশ কমে হয়েছে ৩,২৩৭টি।

চালডালের প্রধান নির্বাহী ওয়াসিম বলেন, তবে অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশের মতো ছোট বাজারে বড় আঘাত এসেছে।

ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হল সহজলভ্য পুঁজি ফুরিয়ে গেছে। ২০০৯-২০১০ এবং২০২২ এ মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ কম সুদের হার নির্ধারণের ফলে বিশ্বে নগদ অর্থ প্রবাহ বাড়ে।

নিম্ন সুদহারের ফলে মূলধন আরও বিদেশী বিনিয়োগে প্রবাহিত হয়। এসময় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডের সংখ্যা বাড়ে। বিনিয়োগকারীদের কাছে নগদ অর্থ প্রবাহের ফলে স্টার্টআপগুলির জন্য তহবিল বাড়তে থাকে।

মহামারির সময় তহবিল সংক্ষিপ্তভাবে সঙ্কুচিত হওয়ার পর ২০২১ সালে আবার বৃদ্ধি পেয়েছে।

যদিও ২০২২ সালে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং উচ্চ চাহিদার ফলে সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হওয়ার কারণে বাজার নিজেই সংশোধিত হয়েছে।

মার্কিন ফেডারেল সুদহার এখন ২২ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। ট্রেজারি বিলের মতো কম ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ এখন তুলানমূলক উচ্চ মুনাফা দেয়। তাই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে আগ্রহ কমেছে।

প্রাথমিক পর্যায়ের ভেঞ্চার ফান্ড সরবরাহ করা অ্যাঙ্করলেস বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং সিইও রাহাত আহমেদ বলেন, এখনো উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।

স্টার্টআপগুলির খারাপ পারফরম্যান্স বিদেশী বিনিয়োগকে প্রভাবিত করবে কিনা জানতে চাইলে রাহাত বলেন, ‘আসলে তেমনটা নয়। খুব প্রাথমিক পর্যায়ের বাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি সম্পর্কে বিনিয়োগকারীরা অবগত। মূলত তারা নিজেদের মোট ফান্ডের একটি ছোট অংশ এখানে বিনিয়োগ করে থাকে।

তিনি বলেন, একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন যে, নিট মুনাফা নেতিবাচক হলেই স্টার্টআপের অবস্থা খারাপ বলা যাবে না। তিনি অ্যামাজনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৯৯৬ সালে সিরিজ এ বিনিয়োগ পায়। কিন্তু ২০০৩ সাল পর্যন্ত লাভজনক ছিল না।

রাহাত আহমেদ বলেন, কোম্পানি কোন পর্যায়ে আছে, তার আকার কত এবং বিনিয়োগকারী কারা তার উপর স্টার্টআপের মুনাফার গুরুত্ব নির্ভর করে।

সিরিজ এ কিংবা সিরিজ বি পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য কোনো গড় সময়কাল নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। মূলত কোন দেশে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠান কোন বিষয় নিয়ে কাজ করে তার উপর নির্ভর করে এসব।

‘তাত্ত্বিকভাবে, একটি স্টার্টআপ যদি তিন বছরে কীভাবে স্কেল করতে পারে তা নির্ধারণ করতে না পারে তবে সম্ভবত সেটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এতে লজ্জার কিছু নেই, কারণ সবকিছু কাজ করবে এমন কোনো কথা নেই। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী উদ্যোগে কাজে লাগানো যেতে পারে।’ যোগ করেন তিনি।

উদাহরণস্বরূপ, উবার প্রতিষ্ঠার আগে কোম্পানিটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা গ্যারেট ক্যাম্প এবং ট্র্যাভিস কালানিকও ব্যর্থ হয়েছিলেন।

ওয়াসিম আলীম বলেন, সমস্যা হলো আমরা বিদেশী বিনিয়োগের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল এবং এর কারণ বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা এবং ব্যাংকগুলো স্টার্টআপের মূল্য বোঝে না।

তিনি আরো বলেন, স্টার্টআপের জন্য ভালো ইকোসিস্টেম তৈরিতে সরকারকে এই বিষয়ে সহায়তা করা উচিত।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.