আজ: রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪ইং, ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১লা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার |

kidarkar

অ্যালায়েন্সের দুই ফান্ডে ইউনিটহোল্ডারদের ক্ষতি ৫৫ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক : সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনাধীন দুই মিউচুয়াল ফান্ডে অনিয়মের কারণে ইউনিটহোল্ডারদের ৫৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা মূলধনি ক্ষতি হয়েছে। ফান্ড দুটির কার্যক্রম নিয়ে চালানো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্তে এ বিষয়টি উঠে এসেছে। এ অনিয়মের ঘটনায় সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এবং এর প্রধান নির্বাহী ও অন্যান্য কর্মকর্তার পাশাপাশি ফান্ড দুটির ট্রাস্টি, নিরীক্ষক ও কাস্টডিয়ানের দায় খুঁজে পেয়েছে বিএসইসি। আজ দৈনিক বনিক বার্তার এক প্রতিবেদনের খবর ।

বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ হিসাব বছর পর্যন্ত অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত এমটিবি ইউনিট ফান্ড ও অ্যালায়েন্স সন্ধানী লাইফ ইউনিট ফান্ডে সংঘটিত অনিয়মের কারণে ইউনিটহোল্ডারদের ৫৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা মূলধনি ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে বেআইনিভাবে এমটিবি ইউনিট ফান্ড থেকে ৩৪ কোটি ৪৪ লাখ ও অ্যালায়েন্স সন্ধানী লাইফ ইউনিট ফান্ড থেকে ৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। দুই ফান্ড মিলিয়ে স্থানান্তর করা অর্থের পরিমাণ ৪২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। তছরুপ করা এ অর্থের বিপরীতে দুই ফান্ডের ১০ কোটি ৩০ লাখ টাকা সুদজনিত ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে এমটিবি ইউনিট ফান্ডে ৮ কোটি ৬২ লাখ ও অ্যালায়েন্স সন্ধানী লাইফ ইউনিট ফান্ডে ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা সুদজনিত ক্ষতি হয়েছে। মনগড়া বা কাল্পনিক সম্পদের ভিত্তিতে দুই ফান্ডের নিট সম্পদমূল্য (এনএভি) হিসাব করার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এতে দুই ফান্ড থেকে পরিচালন ব্যয় বাবদ ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে এমটিবি ইউনিট ফান্ড থেকে ১ কোটি ৬২ লাখ ও অ্যালায়েন্স সন্ধানী লাইফ ইউনিট ফান্ড থেকে ৩৭ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

বিএসইসির তদন্তে উঠে এসেছে, অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফান্ড দুটির শুরু থেকে এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেআইনিভাবে ১৪০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিটির বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেছেন। এর মধ্যে এমটিবি ইউনিট ফান্ড থেকে ১১২ কোটি ও অ্যালায়েন্স সন্ধানী লাইফ ইউনিট ফান্ড থেকে ২৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে দুই ফান্ডে ৯৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এমটিবি ইউনিট ফান্ডে ৭৭ কোটি ৫৬ লাখ ও অ্যালায়েন্স সন্ধানী লাইফ ইউনিট ফান্ডে ১৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা ফেরত এসেছে। এখনো দুই ফান্ডে ৪২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ফেরত আসা বাকি রয়েছে। এর মধ্যে এমটিবি ইউনিট ফান্ডের ৩৪ কোটি ৪৪ লাখ ও অ্যালায়েন্স সন্ধানী লাইফ ইউনিট ফান্ডের ৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা রয়েছে। বিএসইসির তদন্ত কমিটির প্রশ্নের জবাবে সম্পদ ব্যবস্থাপক জানিয়েছে, দুই ফান্ডের টাকা তাদের কাছে স্থানান্তর করা হয়েছিল এবং পুরো অর্থই মোহাম্মদ সাজিদ কটন মিলস লিমিটেড ও সায়মা সামিরা টেক্সটাইলস মিলস লিমিটেডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এ দুটি কোম্পানি সাদ মুসা গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত।

বিএসইসির পর্যবেক্ষণে সম্পদ ব্যবস্থাপক অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বেশকিছু আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করেছে। সম্পদ ব্যবস্থাপক ইউনিটহোল্ডারদের অর্থ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিধিমালা লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি দুই মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বড় অংকের অর্থ বের করে নিয়েছে এবং ব্যক্তিস্বার্থে তা পাচার করেছে। সম্পদ ব্যবস্থাপক ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ানের কাছে ফান্ডের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে লেনদেনের নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ধারাবাহিকভাবে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে আর্থিক বিবরণী তৈরি ও প্রকাশ করেছে। মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা ও আন্তর্জাতিক হিসাবমান অনুসরণ করে প্রান্তিক প্রতিবেদন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিটি। নয় হিসাব বছর ধরে সম্পদ ব্যবস্থাপক ইউনিটহোল্ডারদের অর্থ বেআইনি উদ্দেশ্যে অপব্যবহার করেছে এবং এতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপক মিউচুয়াল ফান্ড থেকে কোনো অগ্রিম অর্থ নিতে পারে না কিংবা কোনো বিনিয়োগের জন্য অগ্রিম অর্থ দিতেও পারে না। যদিও ইচ্ছাকৃতভাবে এবং প্রায়ই সম্পদ ব্যবস্থাপক এ ধরনের কাজ করেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি অজানা উদ্দেশ্যে মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ পাচার করেছে। মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা অনুসারে বিনিয়োগ থেকে আয় না এলে তার কারণ প্রকাশ করতে হয়। যদিও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিটি এ ধরনের কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি, বরং ভুল আর্থিক বিবরণীর মাধ্যমে সবাইকে বিভ্রান্ত করেছে। অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মানি লন্ডারিং আইন ২০১২-এর সেকশন ২(৫) ও সেকশন ৪ অনুসারে অপরাধ করেছেন বলে বিএসইসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের বিষয়ে বিএসইসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদ তাদের ব্যবস্থাপনাধীন দুই মিউচুয়াল ফান্ডের কার্যক্রম নজরদারি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সম্পদ ব্যবস্থাপক যে অসদাচরণ করেছে তার জন্য এর পর্ষদও দায়ী। পাশাপাশি অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কমপ্লায়েন্স অফিসার ও ইনভেস্টমেন্ট কমিটিও সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানটির বেআইনি কর্মকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করছে বিএসইসি।

অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত দুই মিউচুয়াল ফান্ডের ট্রাস্টি বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিজিআইসি) গত বছরের ১৩ নভেম্বর বিএসইসিকে সম্পদ ব্যবস্থাপক কর্তৃক ফান্ড দুটির অর্থ বেআইনিভাবে লেনদেনের বিষয়টি অবহিত করেছিল। তবে ট্রাস্টির বিষয়ে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত ইউনিটহোল্ডারদের অর্থের অপব্যবহারের বিষয়টি জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপক সিকিউরিটিজ আইন পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং ট্রাস্টিও এজন্য দায় এড়াতে পারে না। সম্পদ ব্যবস্থাপক তার দায়দায়িত্ব সঠিকভাবে পরিপালন করেছে কিনা এ ধরনের কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। যদি শুরু থেকেই সম্পদ ব্যবস্থাপকের অনিয়মের বিষয়ে ট্রাস্টি কমিশনকে অবহিত করত তাহলে মূলধনের ক্ষয় হতো না। ফান্ড দুটির কাস্টডিয়ানের দায়িত্বে ছিল ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি দুই মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বেআইনি নগদ অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি নজরদারি করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ সময়ে মিউচুয়াল ফান্ড দুটির নিরীক্ষার দায়িত্বে ছিল একনাবিন, হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি, আজিজ হালিম খায়ের চৌধুরী ও এসএফ আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস। এ সময়ে নিরীক্ষকেরা মিউচুয়াল ফান্ড থেকে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিটির বেআইনি অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফান্ডের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে ডিসকোয়ালিফায়েড মন্তব্য করার মাধ্যমে নিরীক্ষকেরা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ফৌজদারি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ফান্ডের সম্পদের তথ্য যথাযথভাবে যাচাই করা হলে সম্পদ ব্যবস্থাপকের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি আরো আগেই চিহ্নিত করা সম্ভব হতো এবং সে অনুসারে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে নিরীক্ষকেরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে বেশকিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি অ্যালায়েন্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের নিবন্ধন বাতিল করার পাশাপাশি দুই ফান্ডের আর্থিক প্রতিবেদন স্বতন্ত্র নিরীক্ষা করার পর অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হস্তান্তর করার সুপারিশ করা হয়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও খন্দকার আসাদুল ইসলাম, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ, শীর্ষ কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সম্পর্কিত পক্ষ যারা দুই মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ পাচার ও আর্থিক অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অনিয়মের মাধ্যমে পাচার করা অর্থও ইউনিটহোল্ডারদের যে পরিমাণ মূলধনি ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারে কমিশন আইনি উদ্যোগ নিতে পারে। দায়িত্বে ব্যর্থতার কারণে ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান ফি ফেরত দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ফান্ডের নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে বিএসইসির তদন্ত কমিটি।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘মিউচুয়াল ফান্ডে ছোটবড় যেকোনো ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কমিশন সোচ্চার রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের যাতে এ খাতের প্রতি আস্থা বজায় থাকে সেজন্য আমরা তৎপর রয়েছি। কমিশনের তদন্তে অ্যালায়েন্স ক্যাপিটালের বিরুদ্ধে বেশকিছু অনিয়ম পাওয়া গেছে। এ অনিয়মের সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরই মধ্যে সম্পদ ব্যবস্থাপকের পক্ষ থেকে ফান্ডে কিছু পরিমাণ অর্থ ফেরত দেয়া হয়েছে। আমরা চাই যাতে ইউনিটহোল্ডারদের পুরো অর্থ ফেরত আসে।’

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.