নেপথ্যে কি শুধুই শিখ নেতার হত্যাকাণ্ড, বন্ধু থেকে শত্রু
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: একটির ঠিকানা উত্তর আমেরিকা, অন্যটির এশিয়া। দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব ১১ হাজার ৪৬২ কিলোমিটার। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বাণিজ্য সবক্ষেত্রেই ভারতের সঙ্গে কানাডার গভীর সম্পর্ক।
কানাডায় প্রচুর সংখ্যক ভারতীয় বাস করেন। দেশটির মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি ৭০ লাখ। তার মধ্যে অন্তত ১৪ লাখ ভারতীয়। উচ্চশিক্ষা কিংবা চাকরির সূত্রে ভারত থেকে তারা কানাডায় গেছেন। কানাডায় প্রবাসী ভারতীয়ের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
কানাডায় প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে অনেকেই শিখ ধর্মাবলম্বী। সেখানে ৭ লাখ ৭০ হাজার শিখ রয়েছেন। যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ। ভারতে শিখদের অনুপাত কানাডার চেয়ে কম। ভারতের মোট জনসংখ্যার বিচারে শিখদের সংখ্যা মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
কানাডায় ট্রুডোর সরকার গঠনে শিখদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিখরা কানাডার রাজনীতিতেও যথেষ্ট সক্রিয়। কানাডার হাউজ অব কমন্সে ১৮ জন শিখ সংসদ সদস্য রয়েছেন। তাই ট্রুডো বা কানাডার কোনো রাজনৈতিক দলই শিখদের চটাতে চান না।
বাণিজ্যের বিচারেও ভারত-কানাডা সম্পর্ক যথেষ্ট মজবুত। পণ্য আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে এই দুই দেশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ২০২২ সালে কানাডা-ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক আদান-প্রদানের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি।
কানাডা থেকে মূলত সার, কয়লা, কোক, ব্রিকেটের মতো উপাদান আমদানি করে ভারত। ভারত থেকে কানাডায় যায় ভোগ্যপণ্য, যানবাহন, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও পোশাক।
কানাডা সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে ভারত ও কানাডার মধ্যে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার (আমেরিকান) মূল্যের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ৫৭ শতাংশ বেশি।
কানাডা থেকে ভারতে বিনিয়োগও কম হয় না। ভারতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের তালিকায় ১৭ নম্বরে আছে জাস্টিন ট্রুডোর দেশ। ২০০০ সাল থেকে ভারতের বাজারে ৩৬০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ কানাডা থেকে আসে।
শিক্ষাখাতেও কানাডার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ নিবিড়। ভারতের অনেক ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডায় যান। মেধাবী ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কদর আছে কানাডায়।
কানাডায় পড়তে যাওয়া বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ২০১৮ সাল থেকে ভারত কানাডায় বিদেশি শিক্ষার্থী সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎসে পরিণত হয়েছে।
কানাডিয়ান ব্যুরো অব ইন্টারন্যাশানাল এডুকেশনের, ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কানাডায় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩ লাখ ২০ হাজার, যা কানাডার মোট বিদেশি শিক্ষাথীর ৪০ শতাংশ।
তাৎপর্যপূর্ণ হলো গত ২০ বছরের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, ভারত থেকে প্রচুর সংখ্যাক শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষ কানাডায় গেছেন ও সেখানেই থিতু হয়েছেন। মূলত উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানই তাদের উদ্দেশ্য।
কানাডার সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক দুই দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থেই ছিল মজবুত। কিন্তু হঠাৎ গত কয়েক দিনে সেই সম্পর্কে কালোমেঘের ঘনঘটা দেখা দিয়েছে। কানাডার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অনেকটা অবনতি হয়েছে।
কানাডার মাটিতে খালিস্তানপন্থি শিখ আন্দোলনকারী হরদীপ সিংহ নিজ্জরকে হত্যা করা হয় গত জুন মাসে। তিনি ছিলেন খালিস্তানপন্থি সংগঠন ‘খালিস্তান টাইগার ফোর্স’ বা কেটিএফের প্রধান।
দুই অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী ৪৬ বছরের নিজ্জরকে গুরুদ্বার চত্বরে গুলি করে হত্যা করেন। কানাডা সরকারের দাবি, এই হত্যাকাণ্ডে ভারতের ‘হাত’ রয়েছে। পার্লামেন্টের জরুরি অধিবেশনে তেমনই দাবি করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী ট্রু়ডো।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারতীয় এক কূটনীতিককে বহিষ্কার করে ট্রুডো সরকার। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দাবি, নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতীয় এজেন্টদের যোগ থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে তার কাছে। এ বিষয়ে জি-২০ সম্মেলনে তার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথা হয়েছে বলেও জানান ট্রুডো।
ভারতের পক্ষ থেকে কানাডার অভিযোগকে ‘অযৌক্তিক’ ও ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কূটনীতিককে বহিষ্কারের বিষয়েও কড়া সমালোচনা করেছে নয়াদিল্লি।
কানাডার ঢিলের বদলে পাটকেল ছুড়তেও দেরি করেনি ভারত। ভারতে নিযুক্ত কানাডার এক সিনিয়র কূটনীতিককে বহিষ্কার করে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত কয়েক বছর ধরেই কানাডা ও ভারতের সম্পর্কের অবনতির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। ২০২০ সালে ভারতে কৃষক আন্দোলন চলাকালীন সরকারবিরোধী সেই আন্দোলনকে সমর্থন করে বার্তা দিয়েছিলেন ট্রুডো। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে চলা আন্দোলন নিয়ে কানাডায় ভারতীয়দের কাছে উদ্বেগও প্রকাশ করেছিলেন তিনি, যা দিল্লি ভালো চোখে দেখেনি।
কানাডা খালিস্তানপন্থিদের সমর্থন করে তাদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ভারতের। এনআইএ-র পক্ষ থেকে বুধবার বিচ্ছিন্নতাবাদী ও দুষ্কৃতী নেটওয়ার্কে জড়িত ৪৩ জনের তালিকা কানাডা সরকারকে পাঠানো হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে ভারতে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা অনেকেই কানাডায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। কানাডায় খালিস্তানপন্থি বিক্ষোভকারীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গত মার্চ মাসে ভারত সরকার কানাডার হাইকমিশনারকে তলবও করেছিল।
খালিস্তান সমস্যাই ভারত-কানাডা সম্পর্কের অবনতির মূল কারণ। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই দেশের সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেয়, সেটাই এখন দেখার।