পরিচয় সনাক্ত করতে
মরার আগে গাজাবাসী পরছে ব্রেসলেট, এঁকে নিচ্ছে চিহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইসরায়েলের ক্রমাগত বিমান হামলায় গাজা উপত্যকায় যেন লাশের স্তূপ তৈরি হয়েছে। অনেকের পরিচয় সনাক্ত করতে না পেরে বাধ্য হয়ে দেওয়া হচ্ছে গণকবর।
এমন পরিস্থিতিতে গাজায় বসবাসকৃত কিছু পরিবারের সদস্যরা হাতে ভিন্নধর্মী ডিজাইন ও রঙের ব্রেসলেট পরা শুরু করেছে। যাতে করে বোমা হামলায় নিহত হলে মরদেহের অবস্থা যতই খারাপ থাকুক না যেন স্বজনেরা তা সনাক্ত করতে পারেন।
আর গাজার বাসিন্দারা ইসরায়েলের বিমান হামলা থেকে বাঁচতে নানা উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। কেউ হাসপাতালে কিংবা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। ঠিক তেমনি একজন গাজাবাসী আলি এল-দাবা।
গত ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলায় প্রায় ১৪০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। একইসাথে তেল আবিবের দাবি, প্রায় ২২০ জন নাগরিককে জিম্মি করেছে গাজার স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠনটি।
তারই পাল্টা জবাব হিসেবে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে গাজায় ক্রমাগত নির্বিচারে বোমা হামলা করছে ইসরায়েল। এতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছে।
৪০ বছর বয়সী এল-দাবা জানান, গত কয়েকদিনে তিনি বহু মরদেহ দেখেছেন যেগুলো প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। অনেক মরদেহের অবস্থা এতটাই বাজে যে পরিচয় পর্যন্ত সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এমতাবস্থায় এল-দাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, পরিবারের সকলে একসঙ্গে থাকবেন না। বরং ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকবেন। এতে করে একক বিমান হামলায় সকলের একসঙ্গে নিহত হওয়ায় সম্ভাবনা থাকবে না।
এল-দাবা জানান, তার ৪২ বছর বয়সী স্ত্রী লিনা দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ গাজার উত্তরাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন। আর বাবা হিসেবে তিনি নিজে উপত্যকাটির দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিসে অন্য তিন সন্তানসহ আশ্রয় নিয়েছেন।
এল-দাবা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি অর্থাৎ মৃত্যুর জন্যও প্রস্তুত আছেন। তাই তিনিসহ পরিবারের সদস্যরা নীল রঙের ব্রেসলেট হাতে পরেছেন।
এল-দাবা বলেন, “যদি খারাপ কিছু ঘটে; তবে পরিবারের অন্য সদস্যরা হাতের ব্রেসলেট দেখে অন্যদের সনাক্ত করবেন।” ফলে অন্তত পরিবারের পক্ষ থেকে শেষকৃত্য পাওয়া যাবে।
শুধু এল-দাবাই নয়, বরং ফিলিস্তিনের অন্য পরিবারগুলোও নিজেদের জন্য ব্রেসলেট কিনছেন কিংবা বানাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার হাতে নিজের নাম লিখছেন কিংবা সনাক্তকরণ চিহ্ন এঁকে নিচ্ছেন যাতে পরবর্তীতে তা দেখে মরদেহ সনাক্ত করা যায়।
চলমান সংকটময় পরিস্থিতিতে স্থানীয় মুসলিম নেতারা গণকবরের অনুমতি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মরদেহগুলো দাফনের আগে চিকিৎসকরা মৃতদেহগুলোর ছবি তুলে রাখেন ও রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন। একইসাথে প্রতিটি লাশের একটি করে নম্বর দেন যাতে পরবর্তীতে ছবি কিংবা রক্তের নমুনার ওপর ভিত্তি করে তা সনাক্ত করা যায়।
গাজা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ স্থানগুলোর মধ্যে একটি। বিমান হামলা শুরুর পর ইসরায়েলের বাসিন্দাদের উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চল ছেড়ে দক্ষিণাঞ্চলে সরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, ইসরায়েলের বোমা হামলা থেকে বাদ যায়নি দক্ষিণাঞ্চলও। সেখানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েও নিহত হচ্ছেন অনেকেই।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র রয়টার্সকে জানান, হামাস পুরো গাজা উপত্যকা জুড়ে বেসামরিক জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এমতবস্থায় যেখানেই হামাসকে খুঁজে পাওয়া যাবে, সেখানেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটিকে নির্মূল করতে হামলা চালানো হবে। একইসাথে নির্দোষ বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি কমানোর জন্য সম্ভাব্য সকল সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
এছাড়াও গাজায় খাদ্য, পানি ও জ্বালানি প্রবেশাধিকারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তেল আবিব। এমতাবস্থায় উপত্যকাটিতে তৈরি হয়েছে তীব্র মানবিক সংকট। যদিও বিশ্বের বহু নেতা ইসরায়েলের এমন আচরণ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকাল (বুধবার) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় প্রায় ৭৫৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৪৪ জনই শিশু।
আর গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি বোমা হামলায় এখন পর্যন্ত সর্বমোট ৬,৫৪৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে প্রায় ২,৭০৪ জনই শিশু।
এদিকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ নিয়ে একের পর এক বৈঠক করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। গত মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের এক বক্তব্যে ক্ষুদ্ধ হয়েছে ইসরায়েল। তেল আবিব এনিয়ে জাতিসংঘের সাথে রেষারেষিতে জড়িয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, “গাজায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের যে সুস্পষ্ট লঙ্ঘন আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা নিয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমি স্পষ্টভাবে বলছি, একটি সংঘাতে কোনো পক্ষই আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
“ইসরায়েলের ওপর হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা শূন্য থেকে হয়নি। ফিলিস্তিনি জনগণ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের শিকার হয়েছে। তারা তাদের ভূখণ্ড অপরের বসতিতে পরিণত হতে এবং সহিংসতায় জর্জরিত হতে দেখেছে। তাদের অর্থনীতি থমকে গেছে। এই মানুষগুলো বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের দুর্দশার রাজনৈতিক সমাধানের আশাও ধুলোয় মিশে গেছে,” বলেন তিনি।
এদিকে গুতেরেসের এমন মন্তব্যের প্রতিবাদে জাতিসংঘের মহাসচিবের পদ থেকে তার পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে ইসরায়েল।
মহাসচিবের বক্তব্যকে ‘আশ্চর্যজনক’ উল্লেখ করে জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (প্রাক্তন টুইটার) এ করা এক পোস্টে লিখেছেন, “তার (জাতিসংঘ মহাসচিব) এই বক্তব্য সন্ত্রাসবাদ এবং হত্যার পক্ষে একটি সমঝোতা প্রকাশ করে। এটি সত্যিই দুঃখজনক যে, হলোকাস্টের পরে উদ্ভূত একটি সংস্থার প্রধান এমন ভয়ঙ্কর দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন।”