আজ: শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ইং, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

২৭ ডিসেম্বর ২০২০, রবিবার |

kidarkar

করোনার বছরে নির্ভরতায় টেলিকম-তথ্যপ্রযুক্তি খাত

শেয়ারবাজার ডেস্ক: বৈশ্বিক মহামারী করোনায় পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও উলটপালট হয়েছে স্বাভাবিক নাগরিক জীবন, দেশের ব্যবসায় খাত-অর্থনীতি। নতুন নিউ নরমাল বিশ্বে  মানুষের বসবাস এখন।

লকডাউনের মধ্যে ই-কমার্স মাধ্যমে কেনাকাটা কয়েকগুণ বেড়ে যায়, ই-কমার্সগুলো জরুরি সেবা দিতে নেটওয়ার্কের উপর পুরো নির্ভর হয়ে পরে। সভা, সেমিনারসহ সংবাদ সম্মেলন সব অনুষ্ঠিত হতে থাকে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে। প্রথমবারের মতো সরকারের মন্ত্রীসভার বৈঠকও হয় অনলাইনে। ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম, টেলি মেডিসিন সেবাসহ বিভিন্ন অনলাইন সেবায় অভ্যস্ত হয়ে যায় মানুষ।

এই সময়ে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ, ই-কমার্সে কেনাকাটা বেড়েছে ৫০ শতাংশ এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে ৫০ লাখ। আর এ সব কিছুর ব্যাকবোন ছিলো ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক।

যার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে মোবাইল ফোন অপারেটর, ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানসহ এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো।

এছাড়া গ্রামীণফোন ১০ কোটি মিনিট ফ্রি টকটাইম ও ১ টাকায় ৩০ জিবি ডেটা অফার দেয় এই সময়ে। রবিও দেয় ১৩ কোটি মিনিট ফ্রি টকটাইম। রবি ১ কোটি ৩০ লাখ গ্রাহককে ১০ মিনিট করে ফ্রি টকটাইম এবং ৫০ এমবি করে ফ্রি ডেটা দেয়ার ঘোষণা দেয় ।

এলাকাভিত্তিক করোনা ঝুঁকি জানানোর উদ্যোগ নেয় রবি। সবগুলো অপারেটর কলার টিউনে করোনার ঝুঁকি বিষয়ে সচেতন করতে থাকে, যা এখনও চলছে।

এর মধ্যেই নানা ঘটন-অঘটনে প্রায় বছরব্যাপী আলোচনায় ছিলো খাতটি।

পুঁজিবাজারে রবি : বেশ কয়েক বছর ধরে আসি আসি করে শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের মার্চে পুঁজিবাজারে আসতে আবেদন করে দেশের অন্যতম মোবাইল অপারেটর রবি। সাম্প্রতিক সময়ে টেলিকম খাতে অন্যতম বড় ঘটনা এটি।

প্রতি শেয়ার ১০ টাকা হিসেবে ওই মূলধন তোলার জন্য ২৩ সেপ্টেম্বর রবির আইপিও অনুমোদন করে বিএসইসি। ৫২৩ দশমিক ৭ কোটি টাকার প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারের ইতিহাসে বৃহত্তম ইস্যু নিয়ে যাত্রা শুরু করবে রবি। আইপিও কেনার জন্য আবেদনও পড়েছিল ৫ দশমিক ৭৪ গুণ বেশি।

২৪ ডিসেম্বর ঢাকা এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে রবির লেনদেন শুরু হয়।

অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধে চূড়ান্ত কার্যক্রম শুরু : অবৈধ, নকল ও চুরি যাওয়া হ্যান্ডসেট বন্ধে বিটিআরসির চেষ্টা বেশ কয়েক বছরের। ২০১২ সালে প্রথম এই উদ্যোগ নেয়ার পর অবশেষে ২০২০ সালে  তা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। বছরের ২৫ নভেম্বর বিটিআরসির সঙ্গে চুক্তি করে এই কার্যক্রমে প্রযুক্তি সরবরাহ ও পরিচালনাকারী কোম্পানি সিনেসিস আইটি। কোম্পানিটির সঙ্গে এই কাজে জয়েন ভেঞ্চারে এর সঙ্গে রয়েছে রেডিসন টেকনোলজি ও কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড।

চুক্তি স্বাক্ষরের দিন হতে ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) কার্যক্রম চালুর কথা। বিটিআরসি চাইছে, এই ১২০ দিন মানে ২০২০ সালের এপ্রিলের মধ্যেই যেন কার্যক্রম চালু হয়ে যায়।

এনইআইআর চালুর পর হতেই অবৈধ পথে দেশে আসা, ক্লোন বা চুরি করা হ্যান্ডসেটে মোবাইল নেটওয়ার্কে যোগাযোগ করা যাবে না। মানে এসব ফোনে এনইআইআর চালুর কিছুদিনের মধ্যে একদমই কোনো মোবাইল ফোন অপারেটরের সিম চলবে না।

এনইআইআর সিস্টেম চালু হলে সরকার প্রতিবছর চার হাজার কোটি টাকার মত বাড়তি রাজস্ব পাবে।

দেশের তৃতীয় সাবমেরিন প্রকল্পের অনুমোদন : বছরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিনে দেশের তৃতীয় সাবমেরিন প্রকল্পে অনুমোদন দেয় সরকার।

‘বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন’ শীর্ষক এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)।

প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৯৩ কোটি ১৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এতে সরকার দেবে প্রায় ৩০১ কোটি টাকা এবং বাকি ৩৯২ কোটি আসবে বিএসসিসিএল হতে। চলতি বছরের কাজ শুরু হয়ে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এর বাস্তবায়ন সময়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে জানায় সরকার।

সিঙ্গাপুর হতে ফ্রান্স পর্যন্ত সংযুক্ত সি-মি-উই-৬ সাবমেরিন ক্যাবলটি ভারত মহাসাগর, আরব সাগর, লোহিত সাগর হয়ে ভূ-মধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। ক্যাবলটির কোর ল্যান্ডিং স্টেশন হবে সিঙ্গাপুর, ভারত, জিবুতি, মিশর ও ফ্রান্সে।

বাংলাদেশের ব্রাঞ্চটি বঙ্গোপসাগর হয়ে কক্সবাজারের ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

জিপি-রবির ভোল্টি চালু : বছরের শুরুতে ফেব্রুয়ারি মাসে রবি এবং জুন মাসে গ্রামীণফোন মোবাইলে কথা বলার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ভয়েস ওভার এলটিই বা ভোল্টি চালু করে ।

মূলত ফোরজি বা এলটিই নেটওয়ার্কে কথা বলার প্রযুক্তি হলো এই ভয়েস ওভার এলটিই, ভোল্টি, ভোল্টে বা ভোল্ট (VoLTE)।

ভোল্টিতে এইচডি ক্রিস্টাল ক্লিয়ার মানে কথা বলা যায়। যা উপভোগ করা যায় অডিও-ভিডিও দুটিতেই। সাধারণ মোবাইল নেটওয়ার্কে কল করলে তা কানেক্ট হতে ৯ হতে ১১ সেকেন্ড সময় নেয়। ভোল্টিতে এটি দু-তিন বা চার সেকেন্ড লাগে। সাধারণ নেটওয়ার্কে মোবাইলে ভয়েসে আসা-যাওয়ার মাঝখানে যে ডিলে থাকে সেটি ভোল্টিতে থাকবে না। মানে ইন্সট্যান্ট একদম মুখোমুখি কথা বলার মতো এটি আদান-প্রদান হয়। কথা বলতে গিয়ে কেটে কেটে যাওয়ার বিষয়টি একদম থাকে না। কলড্রপ কমে যায়। মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ খরচ হয় অনেক কম। এছাড়া প্রচলিত সুইচ প্রযুক্তির বদলে এই প্রযুক্তিতে ভয়েস কল প্রতি অপারেটরগুলোর খরচও কম পড়ে।

গ্রামীণফোনের এসএমপি ইস্যু : সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) অপারেটর বা একচেটিয়া অপারেটর হিসেবে গ্রামীণফোনের উপর আরোপিত বিধিনিষেধ কার্যকর করা ইস্যু নানা ঘটনায় বেশ আলোচনায় ছিলো বছরটিতে।

এসএমপি  আরোপিত বিধিনিষেধ নিয়ে আদালতে গেলেও শেষ পর্যন্ত চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে আলোচনায় আসে গ্রামীণফোন। আলোচনার জন্য প্রথমে বিটিআরসির নির্দেশনাগুলো পালন শুরু করতে এবং রিট মামলা প্রত্যাহার করে গ্রামীণফোন।

বছরের ২১ জুন এসএমপি বা একচেটিয়া অপারেটর হিসেবে গ্রামীণফোনের উপর দুই বিধিনিষেধ কার্যকরের নোটিস দেয় বিটিআরসি। এতে এমএনপি লকিং পিরিয়ড কমিয়ে দেয়া এবং বর্তমানে চালু সকল সার্ভিস, প্যাকেজ, অফার নতুন করে অনুমোদন নেয়া ও নতুন কোনো প্যাকেজ বা সেবার ক্ষেত্রেও অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে।

এরপর আরও একটি বিধিনিষেধ দেয়া হয়ে। যেখানে কল টার্মেনেটিং রেট কমিয়ে দেয়া হয়। এসব বিধিনিষেধের প্রক্রিয়া নিয়ে হাইকোর্টে রিট করে করে গ্রামীণফোন। এর আগে এই এসএমপি ইস্যুতে আরও দু’বার আদালতে যায় অপারেটরটি। এবং দু’বারই এসএমপি নির্দেশনার বাস্তবায়ন পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল তারা।

১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রামীণফোনকে এসএমপি ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৫ মাস পেরিয়ে ২০২০ সালের জুনে এ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কার্যকরের এই পদক্ষেপ আসে।

অডিট আপত্তি, জিপি-রবির টাকা জমা : অডিট আপত্তিতে গ্রামীণফোনের কাছে বিটিআরসির মোট ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পাওনা দাবি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বিবাদ চলে। যা সরকারের শীর্ষ পর্যায় এবং আদালত পর্যন্ত পৌঁছায়। যা টেলিকম খাতে বেশ আলোচনার ছিলো।

শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রামীণফোন ইস্যুটি সুরাহা করতে এগিয়ে আসে।  সুরাহা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গ্রামীণফোন বিটিআরসিকে দুই দফায় ২০০০ কোটি টাকা জমা দেয়।

দুই দফায় এই ২০০০ কোটি টাকা পরিশোধের পর অডিট আপত্তির পাওনা দাবি ইস্যু সমাধানে নতুন করে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয় এবং উভয় পক্ষ এটি সমাধানে কাজ করছে।

অন্যদিকে রবির কাছে অডিট আপত্তিতে বিটিআরসির দাবির ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা নিয়ে চলে বিরোধ। তবে বছরেরর শুরুর দিকে  ২৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা মঙ্গলবার পরিশোধ করে রবি। আদালত ৫ জানুয়ারি বিটিআরসি-রবির অডিট আপত্তির পাওনা দাবির ইস্যুতে পাঁচ মাসের সমান কিস্তিতে ১৩৮ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছিল।

আইএসপিএবির ঝুলন্ত তার আন্দোলন : বছরের অক্টোবরের মাঝাঝাঝি সময়ে সারাদেশে ইন্টারনেট ও ডিস সংযোগ বন্ধের হুমকি দিয়ে আন্দোলনে নামে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা। যা বেশ আলোচিত হয়েছিলো।

গ্রাহক পর্যন্ত সংযোগ স্থাপনে ঝুলন্ত তারের বিকল্প ব্যবস্থা না করে তার কাটায় ১২ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে ইন্টারনেট ও ডিস সংযোগ বন্ধ করার এই কর্মসূচি দিয়েছিলেন তারা। সেখানে ১৮ অক্টোবর হতে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সারাদেশে বাসা-বাড়ি, অফিস ও ব্যাংকসহ সকল পর্যায়ে ইন্টারনেট ডেটা কানেক্টিভিটি এবং ক্যাবল টিভি বা ডিস বন্ধ রাখার কর্মসূচি ছিলো।

পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, টেলিযোগাযোগ সচিব মো. আফজাল হোসেনসহ দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে কর্মসূচি স্থগিত করেন তারা। এরপর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে বৈঠক করে মাটির নীচ দিয়ে তার নেয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয় এবং কর্মসূচি তুলে নেয় আইএসপিএবি।

শেয়ারবাজার নিউজ/মি

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.