আজ: শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ইং, ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

২৫ জুন ২০১৬, শনিবার |

kidarkar

ব্রেক্সিট: ব্রিটেন কেন বেরিয়ে গেল?

camarunব্রিটেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেল, সেটা কিন্তু স্রেফ চার মাসের উন্মাদনা সৃষ্টিকারী প্রচারণার কারণে হয়নি। এটা হয়েছে ব্রিটিশদের ইউরোপের ব্যাপারে চার দশকের সন্দেহবাতিকগ্রস্ততার কারণে। সময় কখনো ভালো গেছে, কখনো খারাপ গেছে, কিন্তু এই ব্যাপারটা কখনোই হারিয়ে যায়নি।

১৯৭৩ সালে অভিন্ন বাজারব্যবস্থায় প্রবেশ করার পর থেকেই এর বিরুদ্ধাচরণ শুরু হয়। লেবার পার্টির আনুষ্ঠানিক নীতি ছিল এ রকম যে, তারা পরবর্তী এক দশকের মধ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। আবার কনজারভেটিভ পার্টিরও একটি বড় অংশ কখনোই ইউরোপীয় হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে স্বস্তিবোধ করত না।

ডেভিড ক্যামেরন নেতৃত্বে আসীন হওয়ার পর থেকেই দলকে এই ‘ইউরোপ-বিষয়ক একঘেয়ে তর্ক-বিতর্ক’ থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ডাউনিং স্ট্রিটে আসার পর থেকেই দলের পেছনের সারির নেতাদের এই গণভোট আয়োজনের চাপ থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। ওদিকে ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির উত্থান, বিচ্ছিন্ন অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধে গণক্ষোভ ও অভিবাসনের ব্যাপারে জন-অসন্তোষ থাকার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার দাবি জোরালো হয়।

ব্রেক্সিট শব্দবন্ধটা প্রথম শোনা যায় ২০১২ সালে, যেটা গত বছর থেকে প্রধান রাজনৈতিক স্লোগান হয়ে ওঠে। ডেভিড ক্যামেরন আবার এই ইউরোপ সন্দেহপ্রবণ পেছনের সারির নেতাদের সন্তুষ্ট করতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ডানপন্থী ফেডারেলিস্ট গোষ্ঠী ইপিপি থেকে সরে আসেন। কিন্তু কনজারভেটিভ পার্টির ডানপন্থী অংশটি এতেও সন্তুষ্ট হয়নি। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ব্রাসেলসের শাসন হিসেবে দেখত।

২০১০ সালে নির্বাচিত টরি নেতারা ইউরোপের ব্যাপারে আগের নেতাদের চেয়েও বেশি সন্দেহপ্রবণ হওয়ায় ক্যামেরনের বিপদ শুরু হয়। সেই ২০১১ সালের অক্টোবর মাসেই ডেভিড ক্যামেরন বুঝে যান, সামনে সমূহ বিপদ। সে সময় কনজারভেটিভ পার্টির ৮১ জন সাংসদ ব্রেক্সিটের প্রশ্নে গণভোট দাবি করেন।

কিন্তু ২০১২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজেট বৃদ্ধির প্রস্তাবে না ভোট দিয়ে ক্যামেরন ভেবেছিলেন, তিনি মার্গারেট থ্যাচারের ধাঁচের জয় পেয়ে গেছেন। কিন্তু বাস্তবে সে সময় ব্রাসেলসবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়। সে বছরের ডিসেম্বরে বিরস জনসন প্রকাশ্যে ক্যামেরনকে আহ্বান জানান, গণভোট আয়োজনের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ করা হোক।

তবে ক্যামেরনের কিন্তু এ রকম গণভোট আয়োজনের কথা ছিল না, কারণ তারা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, এমন কথা কখনো ভাবেইনি। কিন্তু গত বছর ক্যামেরনের জয়ের পর তাদের আর পেছন ফিরে তাকানোর পথ ছিল না, যেখানে তাঁর জয়ের আংশিক কারণ ছিল এই গণভোটের প্রতিশ্রুতি দেওয়া।

জরিপ থেকে দেখা যায়, ব্রিটেন মূলত তাদের দেশের বিপুল মানুষের অভিবাসনের ব্যাপারে খুবই অসন্তুষ্ট ছিল, যেটা আসলে তাদের ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার মূল কারণ। ব্যাপারটা ছিল এ রকম যে, তারা মুক্তবাণিজ্যের বিনিময়ে মানুষের অবাধ চলাচল চায় কি না। দলে দলে মানুষ ব্রিটেনে বসতি স্থাপনের কারণে সেখানকার চাকরির বাজার ও সরকারি পরিষেবায় ব্যাপক চাপ পড়েছিল, এ কারণেও মানুষের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ওদিকে ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বমুখী সম্প্রসারণ হওয়ার কারণে যে কত মানুষ ব্রিটেনে বসতি স্থাপন করেছে, এই সত্যটা রাজনীতিকেরা স্বীকার না করায় ব্রিটেনবাসীর মনে এ অনুভূতি আরও তীব্র হয়।

২০১০ সালের নির্বাচনের আগে ক্যামেরন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি অভিবাসনের হার কমিয়ে আনবেন। কিন্তু তিনি সে প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। ফলে ২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনি আবারও সে প্রতিশ্রুতি দেন। এতে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। আর মানুষ ধরে নেয়, ব্রিটেনের রাজনীতিকদের অভিবাসনের রাশ টেনে ধরার সামর্থ্য নেই।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষপাতী গোষ্ঠী অভিবাসনের চেয়ে অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নেই বেশি জোর দিয়েছিল, কিন্তু তারা দ্রুতই বুঝে ফেলে, অভিবাসনের ওপর ‘নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার’ ব্যাপারটা সবচেয়ে জোরালো বার্তা। একই সঙ্গে তারা অভিবাসনের সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জায়গার সংকট, ডাক্তারদের নিয়োগসহ মজুরি হ্রাসের প্রসঙ্গগুলো জুড়ে দেয়। আর তার সঙ্গে ব্রাসেলসের ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার ব্যাপারটা তো ছিলই।

তবে ব্রিটেন কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য কখনোই ভোট করেনি। ১৯৯৩ সালে মাসট্রিখ্ট চুক্তির মাধ্যমে আসলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হয়। ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি ছিল তার পূর্বসূরি, যার আওতা ছিল শুধু অর্থনীতি। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের মধ্য দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিচার ও পুলিশিংও এর আওতায় চলে আসে। ত্যাগের পক্ষপাতীরা বলে, ব্রাসেলস আসলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছিল, যেটার জন্য তারা তো এতে যোগ দেয়নি। ফলে যে ইউনিয়নে যাওয়ার জন্য তারা সম্মতি দেয়নি বা তাকে অন্তঃকরণে মেনে নিতে পারেনি, সেখান থেকে তো বেরিয়ে আসাই যায়।

এটা ভোলা যাবে না যে, গণভোটটা এমন সময়ই হলো, যখন অভিজাতদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চারদিকে দানা বেঁধে উঠছিল। ত্যাগের পক্ষপাতীরা সব সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রাসেলসের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিহীন অভিজাত রাজনীতির উৎস হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, যারা ব্রিটেনের জনগণের ভোটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়নি। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের সব সদস্যই নির্বাচিত এবং তাঁদের সবারই নিজস্ব এজেন্ডা আছে, তা সত্ত্বেও তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এ দাবিটা ইউরোপ-বিষয়ক সন্দেহবাতিকগ্রস্তদের মুখের বুলিতে পরিণত হয়।

দেখা গেল, ব্রিটেনের পুরো রাজনৈতিক অঙ্গন এবং টনি ব্লেয়ার থেকে শুরু করে জন মেজরসহ সব সাবেক জীবিত প্রধানমন্ত্রীই থাকার পক্ষে প্রচারণা চালালেও শেষ পর্যন্ত ত্যাগবাদীরাই জয়ী হলো।

তবে একটা কথা বলা যায়, ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টি (ইউকিপ) ও তার নেতা নাইজেল ফারাজের আবির্ভাব না হলে হয়তো ক্যামেরন কখনোই এই গণভোটের ঘোষণা দিতেন না। ২০১৩ সালে স্থানীয় নির্বাচনে দলটি বেশ ভালো করে। এমন আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছিল যে, ক্যামেরন যদি দলের পেছনের সারির নেতাদের গণভোটের দাবি মেনে না নেন, তাহলে হয়তো তাঁরা দলত্যাগও করতে পারেন। এমনকি গণভোটের ঘোষণা দেওয়ার পরও ২০১৫ সালের নির্বাচনে ফারাজের দল কয়েক মিলিয়ন ভোট পায়। তিনি ঘন ঘন গণমাধ্যমে হাজির হয়ে মানুষের মনে অভিবাসনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করেন।

ক্যামেরন শেষ দিকে বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছেন সত্যি, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তিনি অভিবাসীদের সংখ্যা না কমিয়ে তাদের সুযোগ-সুবিধা কমানোর চেষ্টা করেছেন। এমনকি এই ফেব্রুয়ারিতে তিনি এও ঘোষণা করেন যে, অভিবাসীরা ব্রিটেনে আসার পর প্রথম চার বছর সুযোগ-সুবিধা পাবে না, যদিও কীভাবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে, তার রূপরেখা তিনি দেননি।

প্রথম দিকে ব্রেক্সিটকে বিকৃত করে বলা হতো, এটি ডান চরমপন্থী কনজারভেটিভ ও ইউকিপদের ব্যাপার, কিন্তু যখন ক্যামেরনের দুই মহাপ্রতাপশালী বন্ধু বরিস জনসন ও মাইকেল গোভ ব্রেক্সিটের পক্ষে মাঠে নামেন, তখন এটা একরকম বৈধতা পেয়ে যায়। আবার লেবার পার্টিও ক্যামেরনের সমর্থনে জোরসে মাঠে নামেনি। আবার লেবারদের অনেক সমর্থক ইউকিপের দিকেও চলে যায় এই আশায় যে, তারা অভিবাসনের ব্যাপারটা নাগরিক লেবার এমপিদের চেয়ে ভালোভাবে সামাল দিতে পারবে। ফলে যা হওয়ার শেষমেশ তা-ই হলো।

রোয়েনা ম্যাসন: দ্য গার্ডিয়ান-এর রাজনৈতিক প্রতিনিধি।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.