ইন্টারনেট যদি একদিন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়!
শেয়ারবাজার ডেস্ক: বহু মানুষই এখন ইন্টারনেটের ওপর এমনভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে, একদিনের জন্যও ইন্টারনেট পাওয়া না গেলে যেন রীতিমতো দুঃস্বপ্ন শুরু হয়। কিন্তু সত্যিই যদি ইন্টারনেট একদিন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কী হবে, তা জানলে অনেকেই অবাক হবেন। কারণ ইন্টারনেট এখন শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো কোনো বিষয় নয়, এর ওপর নির্ভর করছে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক প্রতিবেদনে বিষয়টি জানিয়েছে বিবিসি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জেফ হ্যানকক তার শিক্ষার্থীদের একটি অ্যাসাইনমেন্টে ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখে সে অভিজ্ঞতা নিতে বলতেন। ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ৪৮ ঘণ্টা ইন্টারনেট বন্ধ রেখে তাদের সে অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতেন। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে বিষয়টি আর সম্ভব হয়নি। কারণ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছিল যে, তাদের এত দীর্ঘ সময় ইন্টারনেটের বাইরে থাকা অসম্ভব ও অনৈতিক!
ইন্টারনেট নির্ভরশীলতা
১৯৯৫ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করত। কিন্তু এর পরের দুই দশকে বিশ্বে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের সাড়ে তিনশ কোটিরও বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তবে যারা নিজ হাতে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তারা ছাড়া অন্যরাও নানাভাবে পরোক্ষ উপায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে বা এর সুবিধা নেয়।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক-পঞ্চমাংশ মানুষ জানিয়েছে, তারা সব সময় ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকে। এছাড়া ৭৩ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে তারা প্রায় প্রতিদিনই ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আর যুক্তরাজ্যের ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ জানিয়েছে তারা গত তিন মাসে অন্তত একবার হলেও ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে।
ইন্টারনেট কী অলঙ্ঘনীয়
ইন্টারনেট যেকোনো সময় বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব, এ বিষয়টি তত্ত্বগতভাবে একেবারেই সঠিক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেট কোনো অলঙ্ঘনীয় বিষয় নয়। বিভিন্ন কারণে সারা বিশ্বের কিংবা কোনো একটি দেশের বা অঞ্চলের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সাইবার আক্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যে ডোমেইন নেম সার্ভারের ওপর ইন্টারনেটের নির্ভরশীলতা, সে সার্ভারগুলোতে হামলা করেই হ্যাকাররা এ ঘটনা ঘটাতে পারে।
এ ছাড়া সারা বিশ্বের সমুদ্রের তল দিয়ে স্থাপিত হয়েছে সাবমেরিন কেবল। এ কেবলগুলো কেটে দিলেই বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে ইন্টারনেটে। এটি সহজে আক্রমণ করা যায় না। কিন্তু নানা ছোট দুর্ঘটনায় এ ধরনের ঘটনার নজির দেখা গেছে। এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে ২০০৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে সাবমেরিন কেবল কাটা পড়ায়। সে সময় মধ্যপ্রাচ্য, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্টারনেট ব্যবস্থায় প্রভাব পড়ে।
কিছু দেশের সরকারের হাতেও রয়েছে ‘কিল সুইচ’। এ সুইচ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া যায় কোনো অংশের ইন্টারনেট। আরব বসন্তের সময় ২০১১ সালে মিসর সরকার এ ধরনের কাজ করেছিল। একই কাজ করেছিল তুরস্ক ও ইরান। চীনের এ ধরনের ‘কিল সুইচ’ প্রস্তুত আছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি আলোচনা করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় ঝুঁকি
ইন্টারনেটের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতটি মহাশূন্য থেকে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি বড় সৌরঝড়ই যথেষ্ট। এতে শুধু ইন্টারনেটই নয়, মহাশূন্যে অবস্থিত স্যাটেলাইট ও পৃথিবীর বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে সৌরঝড়ে।
তবে প্রাকৃতিক কারণে ইন্টারনেটের এ ধরনের বিপর্যয় আসলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ সে ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি চলছে বহু দেশেই।
কাদের ওপর প্রভাব পড়বে?
ইন্টারনেট বন্ধ হলে বিশ্বের শত কোটি মানুষের ওপর যে এর প্রভাব পড়বে, এ বিষয়টি এখন বাস্তবতা। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব কোথায় পড়বে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটনির্ভর বহু মাল্টি বিলিয়ন ডলারের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বলা যায়। মাত্র চার দিন বন্ধ থাকলেই তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট নিরাপত্তার বিষয়ে কর্মরত স্কট বর্গ বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা এক কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ২০টি প্রতিষ্ঠান সর্বাধিক ক্ষতির মুখে পড়বে।
তিনি জানান, বেশ কয়েকটি ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিলিয়ন এমনকি বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কিন্তু কিছু শিল্পে এতটা ক্ষতি না হলেও আংশিকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হবে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে হোটেল, এয়ারলাইন্স ও ব্রোকারেজ প্রাতিষ্ঠান।
জীবনযাত্রা হয়ে পড়বে সেকেলে
মাত্র কয়েকদিন ইন্টারনেট না থাকলেই কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। যেমন অফিস-আদালতের বহু কাজ এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে সঙ্গে সঙ্গে সামনে চলে আসে এবং তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি করা হয়। কিন্তু ইন্টারনেট না থাকলে তা সঙ্গে সঙ্গে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে না। এমনকি কোনো কোনো কাজ তিন দিন পরেও শুরু হতে পারে। ফলে এক্ষেত্রে কমপক্ষে তিন দিন পিছিয়ে পড়তে হবে। ইন্টারনেট না থাকলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগে আবার সেই পুরনো চিঠিপত্রে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। ফলে মানুষের কাজের ধরনেও আমূল পরিবর্তন হবে।
কিছু উৎপাদনশীলতা আবার বাড়বে
ইন্টারনেট না থাকলে শুধু যে ক্ষতি, তা নয়। কিছু ক্ষেত্রে তা উপকারও বয়ে আনবে। যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে বহু মানুষেরই প্রচুর সময় নষ্ট হয়। আর এতে মূল্যবান কাজের সময় কমে যায়। ইন্টারনেট না থাকলে এ সময় রক্ষা করা সম্ভব হবে। ফলে উৎপাদনশীলতা কিছু ক্ষেত্রে বাড়বে।
এ বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য বর্গ ও তার সহকর্মীরা কয়েকটি অফিসের কর্মীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে কাজের সম্পর্ক অনুসন্ধান করেন। এতে তারা দেখেন কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি চার ঘণ্টা কিংবা তার বেশি সময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকে তাহলে বসে না থেকে কর্মীরা কাজে মনোযোগী হয়। আর এতে কাগজপত্র দেখে সঠিকভাবে কাজ করায় কিছুটা কাজের গতিও বাড়ে। তবে এটি সাময়ীক বিষয়। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব একই থাকবে না।
পরিবহন ব্যবস্থা কি বিপর্যস্ত হবে?
ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলেও বিশ্বের বিমানগুলো খুব একটা সমস্যায় না পড়েই সময় মেনে ঠিকঠাক উড়তে পারবে। ট্রেন ও গাড়িগুলোও চলাচল করবে। তবে স্থানীয় পর্যায়ের বাস ও ট্রেনে প্রভাব না পড়লেও দীর্ঘ যাত্রার বাস-ট্রেনে প্রভাব পড়বে। কারণ এগুলোর টিকিট বিক্রি ও বুকিং ব্যবস্থা ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। শুধু যে ভোক্তারাই অনলাইনে বুকিং দেন না। বিভিন্ন বুকিং অফিস থেকেও অনলাইন ব্যবহার করে বিভিন্ন আসন বুকিং দেওয়া হয়। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলে এ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়বে।
মানসিক বিপর্যয়ও ক্ষতি করবে
অনলাইন এখন বহু মানুষেরই সময় কাটানোর উপায়। আর ইন্টারনেট না থাকলে সময় কাটানোর এ উপায় বন্ধ হয়ে যাবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে ব্যক্তি সারাক্ষণ নির্ভর করছে, সে এটি ব্যবহার করতে না পারলে মানসিকভাবে যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বহু মানুষ পরস্পরের সঙ্গে ইমেইল, মেসেঞ্জার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে যোগাযোগ করে। এটি বন্ধ হয়ে গেলে সে সুযোগটিও হারাতে হবে। একইভাবে মানুষের বিনোদনের অভাবও দেখা দেবে। ফলে একাকীত্ব ও উদ্বেগের কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হবে আরও বহু মানুষ।
১৯৭৫ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের একটি টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আগুন লেগে যায়। ফলে ২৩ দিন ধরে ৩০০ ব্লক এলাকায় টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। আর এ সময় এক জরিপে দেখা যায়, সেখানে বসবাসকারী প্রতি পাঁচজনে চারজন ব্যক্তিই জানিয়েছিলেন তারা টেলিফোনের অভাববোধ করছেন। এছাড়া তিন ভাগের দুই ভাগ জানিয়েছিলেন তারা একাকী বোধ করছেন। এছাড়া টেলিফোন সংযোগ চালুর পর তিন-চতুর্থাংশ ব্যক্তি জানিয়েছিলেন তারা নিজেদের মাঝে আগের তুলনায় সংযুক্ত থাকার অনুভূতি পাচ্ছেন।
শেয়ারবাজারনিউজ/মু