ব্যাংক খাতে বেড়েছে নারী কর্মী
ঋণ বিতরণ বাড়লেও সুফল পাচ্ছেন না সব নারী উদ্যোক্তা
এ জেড ভূঁইয়া আনাস: করোনা মহামারি চলাকালে নারী উদ্যোক্তা ফাহমিদা আহমেদ ঝুমা গিয়েছিলেন একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র (এসএমই) খাতের ঋণ নিতে। কিন্তু ব্যাংকটির অ্যাকাউন্টের মাসিক ট্রানজেকশন কম আছে বলে তাকে ঋণ দেওয়া হয়নি। এতে বাধ্য হয়েই শান্তিবাগে অবস্থিত তার কারখানাটি বন্ধ করে দিতে হয়।
শুধু ফাহমিদা আহমেদই নয়, এসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের অনেকেরই এমন অভিযোগ। তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে ঋণের জন্য গেলে বিভিন্ন অঝুহাতে তাদেরকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। যে কারণে তাদের ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি হচ্ছে না বলেও জানিয়েছেন অনেক নারী উদ্যোক্তা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নারী উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
রুমঝুম ফ্যাশনের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নারী উদ্যোক্তা শেয়ারবাজার নিউজকে বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অ্যাকাউন্টের মাসিক ট্রানজেকশন হিসাব করে। সেক্ষেত্রে তারা মাসে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা ট্রানজেকশনের হিসাব চায়। আরও নানা শর্ত। কিন্তু আমরা যতটুকু জানি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী নারী উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার কথা। অথচ ব্যাংকে গেলে তারা বলে, লেনদেন দেখাতে হবে এত টাকা, স্থায়ী ঠিকানা থাকতে হবে, এটা-সোটা নানা রকম টালবাহানা। মূলত তারা ঋণ দিতে চায় না।’ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকঋণের শর্ত বাস্তবিকভাবে কমানোর দাবি তাদের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে সিএমএসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৯৮৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে দেশে প্রচলিত তফসিলি ব্যাংকগুলোয় কর্মরত নারী কর্মীর সংখ্যাও বেড়েছে। গত বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে নারী কর্মী বেড়েছে এক হাজার ১৩৫ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে সিএমএসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ দেয়া হয়েছে চার হাজার ৫৪২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের একই সময়ে এই খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল তিন হাজার ৫৫৩ কোটি ৪৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে বছরের ব্যবধানে সিএমএসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তাদের ৯৮৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বেশি ঋণ দেয়া হয়েছে। তবে নানা শর্তের কারণে ব্যাংকঋণের আওতার বাইরে রয়েছেন অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিডকালে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যেন ক্ষতি সামলিয়ে টিকে থাকতে পারেন, সেজন্য সরকার তাদের কয়েক দফায় স্বল্প সুদে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ দিয়েছে। তারপরও ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের আগ্রহ ছিল খুবই কম। ২০২১ সালে কোভিড পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হওয়ায় নতুন বিনিয়োগের কারণে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে আমদানি-রপ্তানিও।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) মেলায় ব্যাংকগুলোর প্রতি অভিযোগ করে নারী উদ্যোক্তা ও রং বাংলা ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্নিগ্ধা দত্ত জানান, ‘এসএমই ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অনেক কাগজপত্র চায় এবং ঝামেলা করে। কিন্তু বিসিক থেকে সহজ শর্তে দেয়। আমরা তো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্রঋণ চাই আমরা। ব্যাংকগুলো আমাদের কাছ থেকে এমন সব কাগজপত্র চায়, যেটা আমাদের দেয়া সম্ভব নয়। পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা, জামানত, পরিচয়দাতা, জামিনদাতাসহ নানা ঝামেলার কারণে ব্যাংকঋণে অনাগ্রহী বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ঋণের জন্য অনেকেই আবেদন করেছেন। এর মধ্যে কিছু গ্রাহক আছে যারা আগের ঋণ নিয়মিত ফেরত দেয়নি। তাদের ঋণ দিলে ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি আছে। এছাড়া অপ্রয়োজনে কাউকে ঋণ দিলে তা ফেরত পাওয়া নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়। কারণ ঋণ বিতরণ ব্যাংক করবে আদায়ও ব্যাংকগুলোকেই করতে হবে। তাই যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। তবে ভালো গ্রাহকদের ঋণ দিতে সমস্যা নেই। তারা চাইলেই ঋণ পাচ্ছেন।
অন্যদিকে, গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট নারী কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৫১৩ জন, যা ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ছিল ২৮ হাজার ৩৭৮ জন। সে হিসেবে ব্যাংকে নারী কর্মীর সংখ্যা ছয় মাসে বেড়েছে এক হাজার ১৩৫ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ষাণ্মাসিক (জানুয়ারি-জুন) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে মোট এক লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৪ কর্মী বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৫৭ হাজার ২৭১ জন, আর নারী ২৯ হাজার ৫১৩ জন। অর্থাৎ মোট কর্মীর মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে প্রায় ১৬ (১৫ দশমিক ৮০) শতাংশ।
অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে মোট ৫০ হাজার ৫৬৭ জন কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ রয়েছেন ৪২ হাজার ৫৪৪ জন এবং নারী আট হাজার ২৩ জন। মোট কর্মরতের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
তিন বিশেষায়িত বাণিজ্যিক ব্যাংকে মোট কর্মরত রয়েছেন ১৩ হাজার ৩০৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী রয়েছেন ১১ হাজার ৪৭৭ জন এবং নারী রয়েছেন এক হাজার ৮২৮ জন। এখানে নারীদের অংশগ্রহণের হার ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
বেসরকারি ৪২ ব্যাংকে মোট এক লাখ ১৯ হাজার ১১৭ জন কর্মরত আছেন। এর মধ্যে পুরুষ রয়েছেন এক লাখ ৩৯৫ জন, আর নারী ১৮ হাজার ৭২২ জন, যা মোট কর্মরতদের মাত্র ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। আর ৯ বিদেশি ব্যাংকে মোট তিন হাজার ৭৯৫ জনের মধ্যে নারী রয়েছেন ৯৪০ জন।
এসব ব্যাংকে আলোচিত সময়ে বোর্ড সদস্য হিসেবে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকে বোর্ড সদস্য অংশগ্রহণের হার বেশি (১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ)। আলোচ্য সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে এ হার সবচেয়ে কম।