আজ: শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ইং, ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

২৯ নভেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার |

kidarkar

এসএমই মেলায় এক চক্কর

উদ্যোক্তা ও ক্রেতা উভয়েই খুশি

নিজস্ব প্রতিবেদক : বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের নিকটতম আত্মীয় ইলোরা পারভীন। তিনি মূলত সুঁই-সুতো দিয়ে কাজ করেন। এই সুঁই-সুতো দিয়ে ছবি এঁকেছেন পৃথিবীর সব বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের। কে নেই তার সুঁই-সুতোর বুননে। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারেরও ছবি এঁকেছেন। এসব বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ছবি নিয়ে এসেছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি পণ্য মেলায়।

ছবির প্রকারভেদে দামেও ভিন্নতা রয়েছে। এক লাখ থেকে একেবারে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। এই ১২৮ নম্বর স্টলে যে র্দশক, ক্রেতা দাঁড়াবেন তিনি অভিভূত হবেন। গত ৩০ বছর ধরে ইলোরা পারভীন কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশের বাইরেও এই সুঁই-সুতোর বুননে ছবি প্রশংসিত হয়েছে। এসএমই মেলায় এই স্টল যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে।

তিনি জানান, ছোটবেলা থেকে শিল্পী এসএম সুলতানের ছবি আঁকা দেখতাম। আমার আগ্রহ দেখে তিনি বলেন, তোমার যখন এত আগ্রহ তখন তুমি সুঁই-সুতো দিয়ে কাজ করতে পার।

সাবরিনা এসেছেন রংপুর থেকে। তিনি এই মেলায় পসরা সাজিয়েছেন পাটের, হোগলাপাতা ও তালপাতার বিভিন্ন আইটেমসহ ৫০টি পণ্যের। বৈচিত্র্যময় আইটেমে ক্রেতা-দর্শকদের কাছে বেশ কৌতূহল তৈরি করেছে। সুদূর পটুয়াখালী থেকে কমল পাল নিয়ে এসেছেন ৩০০ রকমের মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র। যা দৃষ্টিনন্দন। শুধু তাই নয়, দামের ক্ষেত্রেও সহনীয়। একই ধরনের আইটেম নিয়ে পসরা সাজিয়েছেন মো. আবুল কালাম মিয়া।

‘পোড়া মাটির নকশা কথা’ নামের এই স্টলে রয়েছে আধুনিক ও উন্নতমানের মাটির সামগ্রী। ঢাকার রায়ের বাজারের আবুল কালাম দীর্ঘদিন ধরে এই পেশায় রয়েছেন বলে জানান।

শিল্পী জগদীশচন্দ্র রায় নিজেই টি গাঁও কারু শিল্প নামের একটি স্টল দিয়েছেন। যেখানে নান্দনিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। বিশেষ করে বাটিক শিল্প অতুলনীয়। দাম কিছুটা নাগালের মধ্যে রয়েছে।

টি গাঁও কারুশিল্প, যেখানে দেশি কাপড়ে দেশি রং ও দেশি নকশায় ও দেশি ঢঙে দৃষ্টি আর্কষণ করেছে ক্রেতাদের। তারা নিজেরাই জানান দিচ্ছে, আমরাই প্রথম প্রাকৃতিক কাদা-মাটি দিয়ে কাপড় প্রিন্ট করি। কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার হয় না। নিজস্ব স্টাইলে কাপড়ে ডিজাইন করা হয়।

নবজাতকের স্লোগান হচ্ছে, প্রতি ফোড়ে ভালোবাসা। এখানে যুগলবন্দি কাপল কম্বো পোশাকের সমাহার যেন। দামের ক্ষেত্রে পণ্য হিসেবে বেশ কিছুটা তারতম্য রয়েছে। শাবনাম মুশতারী একজন সফল উদ্যোক্তা, তা তার কর্মে পরিচয় প্রতিফলিত হয়েছে।

তাঁত গ্যালারির ওমর ফারুক প্রতিটি মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। তার অংশগ্রহণ দর্শক ও ক্রেতাদের দৃষ্টি কাড়ে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, তিনি সুতি কাপড়ের ভিন্নতার স্বাদ দেন। দামও বেশ সহনীয়। সিরাজগঞ্জের কাপড় এখন ঢাকায় বসে কে না পেতে চায়? সেই চাওয়া পূরণ করতে এগিয়ে আসেন ওমর ফারুক। তাঁতের পণ্যের আরও একটি স্টল রয়েছে। যেখানে রয়েছে লুঙ্গি থেকে শুরু করে গামছা, কাপড়ের থান। তাঁতের সমাহার মেলায় ভিন্নতা রূপ দিয়েছে।

দয়ীতার সৈয়দ সুলতানা মিলি মেলায় পসরা সাজিয়েছেন হরেক রকম মালা থেকে শুরু করে হাতের বালা, মাথার ক্লিপসহ মেয়েদের যাবতীয় পণ্যের। চোখ ধাঁধানো এই পণ্যের দাম কিছুটা বেশি হলেও ক্রেতা একবার দৃষ্টি দিলেই অনেকটা ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাবে। তবে এর মধ্যেও পছন্দসই পণ্য কিনতে ভুল করবেন না কেউ। তিনি দামের ব্যাপারে ছাড় দিতে নারাজ। এখানে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত পণ্য কেনা যাবে।

কনিকা সুজ ফ্যাক্টরি রাজশাহীর চারঘাটের কালুহাটে। অথচ এই মেলায় বিভিন্ন ধরনের চামড়াজাত পণ্য তৈরি করে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য নিয়ে হাজির হয়েছে কনিকা সুজ। নিজেরা সবাই মিলে কালুহাটি পাদুকা শিল্প সমবায় সমিতি খুলেছে। স্টলে নিয়ে আসা পণ্য ক্রেতাদের আকর্ষণ করছে। আরও অন্য জুতার স্টল রয়েছে এই মেলায়। এর মধ্যে ইমপ্রুভ বিভিন্ন ধরনের জুতাসহ বিভিন্ন আইটেম নিয়ে এসেছে। হরেক রকম জুতা নিয়ে এসেছেন তানহা আখতার মুক্তা। যার স্টলের নাম দিয়েছেন তাম ক্রিয়েশন।

রংপুর ক্রাফটস মেলায় নিয়ে এসেছে নানা ধরনের সতরঞ্চিসহ বিভিন্ন ধরনের আইটেম। নয়ন মণি সরকার জানালেন, পাপোশ ছাড়াও টেবিল ম্যাট নিয়ে এসেছেন।

নিজাম এন্টারপ্রাইজ মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে দৈয়ের বাটি, মাটির ব্যাংক, ফুলের টব, বিভিন্ন সাইজের হালিমের মালসা নিয়ে এসেছে এই মেলায়।

জামদানি শাড়ি অনেক স্থান থেকে এসেছে এই এসএমই মেলায়। কিন্তু দামের ক্ষেত্রে বেশ চড়া মনে করছেন ক্রেতারা। লতিফা বানু নামের একজন ক্রেতা জানালেন, মনে করেছিলাম মেলায় এসে কিছুটা কম দামে কেনা যাবে। কিন্তু দাম শুনে অবাক লাগল। সিদ্দিক সিল্ক হাউস অনেক ধরনের থ্রিপিস, শাড়ি এনেছে। দাম সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ দাম ১৫ হাজার টাকা।

আকর প্রাকৃতিক ক্রাফটস। তারা অনলাইনে আর ফেসবুকে তাদের পণ্য কেনাবেচা করেন। কুমিল্লার পূর্বাশা গিফট অ্যান্ড খাদি ভিন্ন রকমের পণ্য নিয়ে এসেছে। ক্রেতাদের দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছে। আল হেলাল কেনাবেচা নিয়ে আশাবাদী।

রাজশাহী থেকে এসেছেন ইঞ্জিনিয়ার হাসনা আরা বেগম সূচি। ইউটোপিয়া নামের এই স্টলে বুটিকের অনেক পণ্য এসেছে, যা ক্রেতাদের আকর্ষণ করছে। অয়ন ক্রাফটসের নাইমা ইসলাম নিয়ে এসেছেন প্রাকৃতিক ডাইস ও ফেব্রিকস। ফতোয়া থেকে শুরু করে রয়েছে পাঞ্জাবিসহ আরও অনেক ধরনের যাপিতজীবনের পণ্য।

শামীমা পারভীন নিয়ে এসেছেন বিভিন্ন ধরনের পণ্য। রিটা বিবি নামের স্টল এসএমই মেলায় এলেও অনলাইনে কেনাবেচা চলে। সজীব হ্যান্ডি ক্রাফটসের মো. আখতার হোসেন নিয়ে এসেছেন পুঁতি দিয়ে কলমদানি, ফুলদানি, টিস্যুবক্স, ওয়ালমেট, কালারফুল ঝাড়বাতিসহ আরও অনেক পণ্য। যা ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

মেহেরুন্নেসা মিলি সিরামিক, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের আইটেম নিয়ে পসরা সাজিয়েছেন। মিলি ক্রিয়েশন নামের এই স্টলে ক্রেতাদের আগ্রহের কমতি নেই। মোসাম্মৎ লায়লা ইয়াসমিন অনলাইনে কেনাবেচা করলেও প্রতি মেলায় তার অংশগ্রহণ রয়েছে। মুয়াজ কালেকশন নামের এই স্টল ক্রেতাদের আকর্ষণ করছে।

বসন বুটিক নামের স্টলে এসেছে হরেক রকম পণ্য। এই স্টলের মালিক আইরিন ভূঁইয়া বাংলাদেশ উইমেন চেম্বারের একজন সদস্য। নারায়ণগঞ্জের এই উদ্যোক্তা একজন সফল হিসেবে সুপরিচিত। আহমেদ জামদানি নিয়ে এসেছে বিভিন্ন ধরনের জামদানি পণ্য। মো. তৌকির আহমেদ ও মো. মনির হোসেন ফেসবুকেও কেনাবেচা করেন বলে জানা গেছে। বুনো কাঠের দীন মোহাম্মদ শিবলী একটু বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছেন। তিনি মন্ডল নিয়ে এসেছেন হরেক রকম জুতা। ইচ্ছাতাই নিয়ে এসেছে হস্তশিল্প। যা দৃষ্টিনন্দন। এসএম শাহরিয়ার আবেদীন বিভিন্ন ধরনের জুতা নিয়ে এসেছেন এই মেলায়। যা ক্রেতাদের দৃষ্টি কাড়ছে। গোল্ডেন ব্রেইড ফুটওয়্যার লি. নামের স্টল নিয়ে জুতার সব পণ্যের পসরা সাজিয়েছে।

তরঙ্গ। যেন জলের মধ্যে কাঁপন। কোহিনূর ইয়াসমিন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নান্দনিক পসরা সাজিয়েছেন, যা ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পরিবেশবান্ধব সব পণ্য যেন বাড়তি নজর কাড়ছে।

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের পসরা মেলায় কমতি নেই। প্রতিটি স্টলে যেন ভিন্নতা রয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুর রহমানের তথ্য অনুযায়ী এবারের মেলায় ৪০০টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে। এই মেলার উদ্দেশ্য হচ্ছে মূলত চারটি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রচার, প্রসার, বিক্রি ও স্থানীয় পর্যায়ে বাজার সম্প্রসারণ। এর পাশাপাশি পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন, যোগাযোগ ও সেতুবন্ধন তৈরিতে সহায়তা করা।

২০১২ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন প্রথম এই মেলা শুরু করে। সেই থেকে আর থেমে নেই এই যাত্রা। এবার এই মেলায় বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহায়তা করছে। যা উদ্যোক্তা ও ক্রেতাদের জন্য সহায়ক। গত ২৪ নভেম্বর শুরু হওয়া এই মেলা আগামী ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে বলে জানা গেছে। এসএমই ফাউন্ডেশন এই মেলার আয়োজক হিসেবে উদ্যোক্তা ও ক্রেতাদের কাছে প্রশংসার দাবি রাখে।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.