শুল্ক নিয়ে বিপিসি-কাস্টমস টানাপোড়েন
# চূড়ান্ত দাবিনামার পরও পরিশোধ হয়নি ১০১ কোটি টাকার অনাদেয় শুল্ক
# বিপিসি চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েও মেলেনি সমাধান
# দুই মাস ধরে পদ্মা অয়েলের একটি ফার্নেস অয়েলের বন্ডেড ট্যাংক সিলগালা
রোহিত হওয়া এসআরও’র (সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ) সুবিধা নিয়ে আমদানি করা ফার্নেস অয়েল খালাস নেয় রাষ্ট্রীয় তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এতে ২০২১ সালের প্রথম দিকে আমদানি করা ফার্নেস অয়েলের ১৯টি চালান খালাসের বিপরীতে প্রায় ১০১ কোটি টাকার বেশি শুল্ক কম দেয় বিপিসি। বিপিসির পক্ষে শুল্কায়নের কাজটি করে আসছিল নিয়ন্ত্রণাধীন বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পাানি।
বিষয়টি নিয়ে জাতীয় রাজস্ব রোর্ড (এনবিআর), বিপিসি ও পদ্মা অয়েলের মধ্যে প্রায় এক বছর দফায় দফায় বৈঠক এবং চিঠি চালাচালির পর চূড়ান্ত দাবিনামাও জারি করে চট্টগ্রাম কাস্টমস। পরে বিপিসি চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েও সাড়া না পাওয়ায় গত ২৮ জুন পদ্মা অয়েলের ৬১ লাখ লিটারের একটি বন্ডেড ট্যাংক সিলগালা করে দেয় কাস্টমস। সিলগালার দুই মাস পার হয়ে গেলেও সমস্যার সুরাহা না হওয়ায় ট্যাংকে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকা ফার্নেস অয়েলের মান স্বাভাবিক রাখা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের শুরুতে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে এমটি লাকাটামিয়া, এমটি কিংফিশার ও এমটি এলাইচ-১ জাহাজে করে প্রায় ৪৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করে বিপিসি। পরবর্তীসময়ে ফার্নেস অয়েলের চালানগুলো রোহিত হওয়ায় ২০১১ সালের একটি এসআরও (এসআরও নম্বর-২০-আইন/২০১১/২৩২৭/শুল্ক) এর রেয়াতি সুবিধায় খালাস নেওয়া হয়। ওই এসআরওটি ২০২০ সালের ৩ জুনের তারিখের আরেকটি এসআরও (এসআরও নম্বর-১২০- আইন/২০২০/৭১/ কাস্টমস) দ্বারা রোহিত করা হয়। ২০২০ সালের ১১ জুন থেকে নতুন এসআরওটি কার্যকর হওয়ায় অকার্যকর হয়ে যায় আগের ২০১১ সালের ২০ নম্বর এসআরওটি। এতে বাতিল করা হয় আগের এসআরওর রেয়াতি সুবিধা।
এতে এমটি লাকাটামিয়া, এমটি কিংফিশার এবং এমটি এলাইচ-১ জাহাজে করে আসা প্রায় ৪৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল রেয়াতি সুবিধায় খালাস নিয়ে ১০১ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৩৩৬ টাকা ৯৬ পয়সা শুল্ক কম পরিশোধ করা হয় উল্লেখ করে এসব অনাদেয় শুল্ক পরিশোধে দাবিনামা জারি করে কাস্টমস। পরবর্তীসময়ে খালাস করা এসব ফার্নেস অয়েল পুরোনো এসআরওর রেয়াতি সুবিধায় শুল্কায়নের অনুরোধ জানিয়ে সবশেষ ১৬ মে এনবিআরের দ্বারস্থ হয় বিপিসি। পরে ১৫ জুন এনবিআরের কাস্টমস ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নিরীক্ষা শাখার দ্বিতীয় সচিব নাজমুন নাহার স্বাক্ষরিত এক পত্রে উল্লিখিত ১৯টি বিল অব এন্ট্রিতে রেয়াতি সুবিধা প্রযোজ্য নয় উল্লেখ করে ১০১ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৩৩৬ টাকা ৯৬ পয়সা অনাদেয় শুল্ক দ্রুত পরিশোধের জন্য বিপিসি চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানানো হয়।
এদিকে এনবিআর থেকে রেয়াতি সুবিধায় শুল্কায়নের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর গত ২৭ জুন অনাদেয় শুল্ক পরিশোধে পদ্মা অয়েল কোম্পানিকে চূড়ান্ত তাগাদাপত্র দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস। চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার ড. আবু নুর রাশেদ আহম্মেদ স্বাক্ষরিত ওই পত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল এনবিআর চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে পেট্রোবাংলা, বিপিসি ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর অনাদেয় ১০১ কোটি ৮৩ লাখ টাকার শুল্ক নিরঙ্কুশ এবং পূর্ণ আদায়যোগ্য উল্লেখ করে এনবিআরের পক্ষ থেকে এসব শুল্ক আদায় ও পরিশোধের জন্য বিপিসি চেয়ারম্যান, পদ্মা অয়েল কোম্পানি ও চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পরবর্তীসময়ে বিপিসির দেওয়া রেয়াতি শুল্কায়নের আবেদন গত ১৬ মে এনবিআর থেকে নামঞ্জুর করে অনাদেয় শুল্ক দ্রুত পরিশোধের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপরও অপরিশোধিত শুল্ক-করাদি ১০১ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৩৩৬ টাকা ৯৬ পয়সা ৩০ জুনের মধ্যে পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। পরে পদ্মা অয়েল কোম্পানি বিন (বিজনেজ আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) লকসহ পণ্য খালাস বন্ধ করা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার কথা বলা হয় পত্রে।
এদিকে ওই পত্রের পরের দিন ২৮ জুন পদ্মা অয়েল কোম্পানির পতেঙ্গা গুপ্তখালের প্রধান স্থাপনায় ৭৯ নম্বর বন্ডেড ট্যাংক সিলগালা করে দেয়। এর পরের দিন পদ্মা অয়েলের পক্ষ থেকে প্রধান স্থাপনার দায়িত্বে থাকা সহকারী মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোস্তাক আহমদ চৌধুরী ওই ট্যাংকের সিলগালা খুলে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারকে চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, ট্যাংকটিতে সিল করার কারণে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেশি-বিদেশি জাহাজের জ্বালানি তেল সরবরাহ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে জ্বালানি সংকট দেখা দিতে পারে।
জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় রেখে জ্বালানি সরবরাহ কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার জন্য সিল করা ট্যাংকটি (তৈলাধার) খুলে দেওয়ার অনুরোধ জানান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ ইকবাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাস্টমসের দাবি করা শুল্ককর ও সিলগালা করা ট্যাংক খুলে দেওয়ার বিষয়ে এখনো কথাবার্তা চলছে। আশা করছি একটি সুন্দর সমাধান হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, দাবি করা অপরিশোধিত শুল্ক পরিশোধ করা না হলে সিলগালা করা ট্যাংক খুলে দেওয়ার সুযোগ নেই। এসব শুল্ক পরিশোধ করা না হলে ভবিষ্যতে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও ফ্রিজ হতে পারে।
এ বিষয়ে কাস্টমসের দুই নম্বর সেকশনের ডেপুটি কমিশনার রোখসানা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোহিত হওয়া একটি এসআরওর রেয়াতি সুবিধা ব্যবহার করে ২০২১ সালের শুরুতে ফার্নেস অয়েলের ১৯টি চালান খালাস নেয় পদ্মা অয়েল কোম্পানি। এসব চালানে প্রায় ১০২ কোটি টাকার মতো শুল্ক কম পরিশোধ করা হয়েছে। পরবর্তীসময়ে কাস্টমসের পিসিইউর (পোস্ট ক্লিয়ারেন্স ইউনিট) তদন্তে শুল্ক কম দিয়ে ফার্নেস অয়েল খালাস দেওয়ার বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়। এরপর এনবিআর থেকে এসব অপরিশোধিত শুল্ক আদায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ নিয়ে বিপিসি, পদ্মা অয়েলের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে। এখন জারি করা হয়েছে চূড়ান্ত দাবিনামা। বাধ্যতামূলকভাবে এসব অপরিশোধিত শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমসের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘পদ্মা অয়েল কোম্পানি বিলুপ্ত হওয়া একটি এসআরও’র দেখিয়ে রেয়াতি সুবিধা নিয়েছে। এটি মিথ্যা ঘোষণার শামিল। এ ধরনের অপরাধে অপরিশোধিত শুল্ক বাদেও দ্বিগুণ জরিমানার বিধান রয়েছে। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এখনো জরিমানা করা হয়নি। তারপরও তারা কম দেওয়া রাজস্ব পরিশোধেও টালবাহানা করছে।