আজ: বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ইং, ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবার |

kidarkar

জলবায়ু পরিবর্তন, সংকটে ইলিশ

শাহ আলম নূর : মৌসুমের শেষ সময়ে এসে বাজার ভরে উঠেছে ইলিশে। চকচকে তাজা ইলিশ কিনতে বাজারে ভিড় করছেন ক্রেতারা। কম দামে ইলিশ কেনার আশায় দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা ছুটছেন উপকূলের ইলিশের বড় বাজারগুলোতে। দামও তূলনামূলক কম। তবে এ বছর গোটা ইলিশ মৌসুমের চিত্র এটি নয়। মৌসুমের অধিকাংশ সময় সর্বত্রই ছিল ইলিশ সংকট। সমুদ্রের মোহনায় জেলের জালে অল্প ইলিশ ধরা পড়লেও নদীতে ইলিশের দেখা মেলেনি। এখন সমুদ্রের মোহনা অথবা আরো গভীরে কিছু ইলিশ পাওয়া গেলেও নদীতে জেলের জালে ইলিশ মিলছে খুব সামান্য। গত কয়েক বছর ধরেই নদীর ইলিশ কমে গেছে, দাবি সংশ্লিষ্টদের। গবেষকরা এটাকে বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
পদ্মা, মেঘনা এবং ডাকাতিয়া নদীর মিলিত স্রোতবিধৌত চাঁদপুর ‘ইলিশের বাড়ি’ বলে খ্যাত। ইলিশের মৌসুমে চাঁদপুরের ইলিশ বাজার মুখর হয়ে ওঠে ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায়। সমুদ্র ও নদীর ইলিশ জড়ো হয় এই বাজারে। এখান থেকে ইলিশ যায় দেশ-বিদেশের বাজারগুলোতে। দূর-দূরান্ত থেকে বহু ক্রেতা ইলিশ নেন এই বাজার থেকে। কিন্তু এবছর মৌসুমের অধিকাংশ সময়ে এই বাজার ছিল মন্দা। পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ইলিশের দেখা মেলেনি। জাল ফেলে জেলেরা অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনে শেষ অবধি ফিরেছেন খালি হাতে। মাঝি (যিনি নৌকা/ট্রলারের সব জেলের নেতৃত্ব দেন) দেনা হচ্ছেন মৎস আড়তদারের কাছে; জেলেরা (যারা ভাগী বলে পরিচিত) দেনা হচ্ছেন মাঝির কাছে।

হরিণা খালে ভিড়েছে পদ্মার ইলিশ-নৌকা
চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত যুগ যুগ ধরে। ইলিশ ঘিরেই চাঁদপুর হয়ে উঠেছে ‘ইলিশবাড়ি’। সরকারিভাবে জেলা পরিচিতির থিম চাঁদপুরকে ‘ইলিশবাড়ি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মিথ আছে, মা-ইলিশ যেমন বাবার বাড়ি (পদ্মা-মেঘনা নদীতে) এসে ডিম ছাড়ে, তেমনি ছোট বয়সে (ঝাটকা) ইলিশ নানার বাড়িতে (পদ্মা-মেঘনা নদীতে) বড় হয়। এরপর ইলিশ ক্রমে সমুদ্রের দিকে যেতে থাকে। বড় হয়ে তারা আবার সমুদ্র থেকে নদীতে ফিরে আসে। বর্ষায় ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ইলিশদের আন্দোলিত করে; জেলেরা অপেক্ষা করেন কখন ইলিশ এসে ধরা পড়বে জালে। চাঁদপুরের ইলিশের সেই মিথ হয়তো ভেঙে যেতে বসেছে।চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ পাওয়া এখন জেলেদের ‘সৌভাগ্যের’ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।পদ্মা-মেঘনা তীরের বহু জেলে তাই দেনায় জড়িয়ে পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

হরিসভা থেকে হরিণা
হরিসভা থেকে হরিণা; চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা তীরের দূর্ঘ ইলিশ বিচরণ ক্ষেত্র। এক সময় এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই ইলিশ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এই এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে বহু জেলে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
অনেক জেলে পেশা ছেড়ে দিয়েছে, নৌকা উঠিয়ে রেখেছে তীরে
হরিসভা চাঁদপুরের মেঘনা তীরের খুব পরিচিত একটি এলাকা।ইলিশের মৌসুমে এখানে মেঘনা নদীতে এক সময় দেখা যেত অসংখ্য মাছ ধরার নৌকা। নদীর তীরে থাকতো জেলেদের ব্যস্ততা। কিন্তু এবছর হরিসভা এলাকায় সে দৃশ্য চোখে পড়েনি।স্থানীয় জেলে সূত্রগুলো বলেছে, হরিসভা এলাকা থেকে চাঁদপুর পুরান বাজার অবধি অন্তত তিন হাজার জেলে আছে। এদের মধ্যে অন্তত এক হাজার নিবন্ধিত জেলে। এই জেলেদের অন্তত ৮০ শতাংশ এখন বেকার। জেলে কার্ড নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে জেলেদের। আবার কার্ড পেলেও ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ সময়ে সরকারি সহায়তা না পাওয়া নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই। এসব অভিযোগের চেয়েও এখন পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ না-পাওয়া নিয়ে জেলেদের দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি।

বিশ বছর ধরে অন্যের নৌকায় ইলিশ ধরতেন হরিসভা এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। হলি নৌকায় বাতাজাল ফেলতেন তিনি। এই নৌকাগুলোতে ৪-৫ জন জেলে মাছ ধরে। আহরিত ইলিশের অর্ধেক মাঝির (মালিকের), বাকিটুকু অন্য জেলেরা সমান ভাগ পান। নদীতে ইলিশ কমে যাওয়ায় আনোয়ার এ বছর ইলিশ ধরতে যাননি। এখন তিনি অন্য কাজে জীবিকা নির্বাহ করছেন। একই এলাকার বাসিন্দা আয়নাল হক গাজী প্রায় অর্ধজীবন কাটিয়েছেন জেলে পেশায়। বাড়ির কাছে মেঘনা নদীতে ইলিশ ধরেন ছোটবেলা থেকে। এক সময় নিজের নৌকা ছিল। অন্য জেলেদের ‘ভাগী’ নিয়ে ইলিশ ধরতে যেতেন নদীতে। ইলিশ ধরতে গিয়ে একবার সাইক্লোনে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন। এরপর থেকে আজ অবধি তিনি অন্যের নৌকায় ইলিশ ধরেন। এ বছর ইলিশ তার জীবিকা নির্বাহের পথ দেখাতে পারেননি। গোটা মৌসুমে ১০-১৫ হাজার টাকা হাতে পেয়েছেন। এই এলাকার জেলে রহমান তাইনি সাত বছর আগে ইলিশ ধরা ছেড়ে বাড়ির সামনে দোকান নিয়ে বসেছেন।
হরিসভা থেকে আরো দক্ষিণে এগোলেও একই ছবি। নদীতে ইলিশের নৌকা খুব চোখে পড়েনি। বরং নদীর তীরে উঠোনো ছিল অনেকগুলো নৌকা। এই নৌকাগুলো হয়তো নদীতেই থাকতো, যদি ইলিশ পাওয়া যেত। ছোটবেলা থেকে ইলিশ ধরা জেলে চল্লিশ বছর বয়সী আবদুল হালিম সামনের জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায়। ঘাটে বাধা আছে তার পাঁচটি নৌকা। এক সময় পুরো উদ্যোমে জেলেদের নিয়ে পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ ধরেছেন তিনি। কিন্তু এখন তাকে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে।
হরিসভা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে হরিণা। এলাকাটি চাঁদপুর সদর উপজেলার হানারচর ইউনিয়নের আওতাধীন। শুধু ইলিশ ধরা এবং বেচাকেনা নয়, হরিণা ফেরিঘাট ঘিরেও এখানে সবসময় থাকে জমজমাট পরিবেশ। এপারে হরিণা ফেরিঘাট ওপারে শরীয়তপুর জেলার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। হরিণাঘাটে আছে একটি ইলিশ বাজার। কিন্তু এখানেও ইলিশের ভরা মৌসুমে নেই কারো ব্যস্ততা। আবুল কাশেম কালু হাওলাদার হরিণা ইলিশ বাজারে ব্যবসা করছেন প্রায় ২৫ বছর ধরে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসা নিয়ে তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এবছর ৩০টি জেলে নৌকায় আবুল কাশেম ৩০ লক্ষ টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। এই টাকা উত্তোলন তার জন্য খুব কঠিন হবে।
এ বছর লোকসানে জেলে বাতেন শেখ। চাঁদপুরের হানারচরের হরিণা খাল থেকে তোলা ছবি
পদ্মা থেকে আসা জেলে নৌকাগুলো ভেড়ে হরিণা খালে। সেখানে তারা আবার নদীতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কাজের মাঝেই কথা হয় সেখানে কয়েকজন জেলের সঙ্গে। না, তাদের অবস্থাও এ বছর ভালো নাই। অন্য কাজ নাই বলে ইলিশ ধরতে নেমেছেন। কিন্তু পরিশ্রম প্রায় বৃথা। ১০ জনের জেলে বহর আবদুল বাতেন শেখের। খুব ভোরে পদ্মায় নেমেছিলেন ইলিশ ধরতে। দুপুর ১২টা অবধি ফিরেছেন। ইলিশ পেয়েছেন মাত্র চার হাজার টাকার। আবদুল বাতেন বলেন, এবছর এদিকে ইলিশ খুব কম। অন্যদিকে তেলের মূল্য বৃদ্ধি আমাদের জন্য বাড়তি চাপ। খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমরা লোকসানে আছি।
বিচরণক্ষেত্র বিপন্ন
ইলিশ-জেলেসহ সংশ্লিষ্ট সবার একই অভিযোগ, নদীতে ইলিশের বিচরণক্ষেত্র বিপন্ন। ঢাকার বুড়িগঙ্গা বেয়ে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় প্রবেশ করছে দূষিত পানি, নষ্ট হচ্ছে ইলিশের খাদ্যচক্র। অন্যদিকে দক্ষিণে ডুবোচরের কারণে ইলিশের বিচরণক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে মানবসৃষ্ট আরো অনেক কারণ। পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের ডিম ছাড়ার পরিবেশ নেই বলে দাবি করেন জেলেরা। তারা বলেন, ইলিশ ডিম ছাড়তে আসতো পদ্মা-মেঘনায়। কিন্তু মানুষসৃষ্ট অনেক কারণে ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে জাটকা মৌসুমে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একটি অসাধু চক্র জাটকা ধরছে। ফলে ইলিশ মৌসুমে ইলিশ মিলছে না।
অনেক বছর ধরে ইলিশ ধরায় অভিজ্ঞ জেলে আয়নাল হক গাজী মেঘনা নদীর দিকে তর্জনী তুলে বলেন, আগে আমরা এই নদীতে অনেক ইলিশ পেয়েছি। ইলিশ ধরতে আমাদের কোনো বাধা ছিল না। এখন সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে। বছরের সব সময় আমরা ইলিশ ধরতে পারছি না। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় নদীতে ইলিশ কমে গেছে। অনেক স্থানে নদীর গভীরতা কমে গেছে। ইলিশ চলাচল করতে পারছে না। ইলিশের জন্য নদীতে স্রোত প্রয়োজন। কিন্তু স্রোত আগের চেয়ে কমে গেছে। দক্ষিণে সমুদ্রের নিকটবর্তী এলাকায় অনেক চর পড়েছে। ফলে ইলিশ নদীতে প্রবেশ করতে পারছে না। নদীতে ইলিশ কমে যাওয়ায় জেলের সংখ্যাও কমে গেছে। আয়নাল হকের কথায় সায় দেন হরিণার নেওয়াজ আলী পাঠান, হাবিবুর রহমানসহ আরো অনেক জেলে।
নদীতে ইলিশ কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরের ইলিশ বাজারে। চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতি সূত্র বলেছে, এ বছর ইলিশ মৌসুমের অধিকাংশ সময়জুড়ে বাজারে ছিল মন্দাভাব। নদী থেকে চাঁদপুরের বাজারে ইলিশ এসেছে অনেক কম। অধিকাংশ ইলিশ ছিল সমুদ্র অথবা সমুদ্র মোহনা থেকে আসা। এ বছর মন্দা সময়কালে চাঁদপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে দৈনিক ইলিশ এসেছে ৪-৫শ’ মণ। অথচ অন্যান্য সময়ে ইলিশের পিক মৌসুমে এখানে দৈনিক ইলিশ আসে ২-৩ হাজার মণ।
চাঁদপুর বণিক সমিতির সভাপতি আবদুল বারী জোমাদার মাণিক বলেন, পরিবেশগত সমস্যা, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। বৃষ্টিপাত এবছর অনেক কমে গেছে। গবেষকেরা বলেছেন, ৪১ বছরের মধ্যে এবছর সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই অবস্থাগুলো ইলিশ উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে।বৃষ্টি হলে ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীর দিকে উঠে আসে। বৃষ্টি না হওয়ায় সেটা হচ্ছে না। ইলিশের ইকোসিস্টেম বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি, দূষণ বৃদ্ধি, ডুবো চর সৃষ্টি ইত্যাদি কারণগুলোও ইলিশ উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করছে।
চাঁদপুরের ইলিশ বাজার
বিভিন্ন কারণে চাঁদপুরের ইলিশ বাজার ঝিমিয়ে পড়ছে বলে দাবি করেন আবদুল বারী জোমাদার মাণিক। তিনি বলেন, ২০ মে থেকে সাগরে ৬৫ দিনের মাছধরা নিষিদ্ধ রাখে সরকার। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের সমন্বয় থাকে না। অথচ ৬৫ দিনের এই নিষেধাজ্ঞা হওয়া উচিত ট্রান্সবাউন্ডারি অবরোধ। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে এটা করা উচিত। শুধু ৬৫ দিন কেন, বছরের অধিকাংশ সময়ই তো কোনো না কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে। আমরা মাছের ব্যবসা করবো কীভাবে।পরিবেশগত সংকট বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা ইলিশ উৎপাদনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে; ইলিশ-জেলে এবং ইলিশ-ব্যবসায়ীদের এই মতের সাথে একমত ইলিশ-গবেষকেরা। বিভিন্ন সময়ে ইলিশ গবেষণায় উঠে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদীতে ইলিশ বিচরণে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছেন ইলিশ গবেষকেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইলিশ গবেষক বলেন, ইলিশের উপাদন বাড়াতে সরকারের তরফে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরে এর সুফলও পাওয়া গেছে। ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল সকলেই পাচ্ছে।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.